পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Qや রবীন্দ্র-রচনাবলী কেকারব কানে শুনিতে মিষ্ট নহে, কিন্তু অবস্থাবিশেষে সময়বিশেষে মন তাহাকে মিষ্ট করিয়া শুনিতে পারে, মনের সেই ক্ষমতা আছে। সেই মিষ্টতার স্বরূপ, কুহুতানের মিষ্টত হইতে স্বতন্ত্র । নববর্ষাগমে গিরিপাদমূলে লতাজটিল প্রাচীন মহারণ্যের মধ্যে যে মত্তত উপস্থিত হয় কেকারব তাহারই গান । আষাঢ়ে শুামায়মান তমালতালীবনের দ্বিগুণতর ঘনায়িত অন্ধকারে, মাতৃস্তন্যপিপাস্ব উর্ধ্ববাহু শতসহস্র শিশুর মতো অগণ্য শাখাপ্রশাখার আন্দোলিত মর্মরমুখর মহোল্লাসের মধ্যে, রহিয়া-রহিয়া কেকা তারস্বরে যে একটি কাংস্তক্রেংকারধ্বনি উখিত করে তাহাতে প্রবীণ বনম্পতিমণ্ডলীর মধ্যে আরণ্য মহোৎসবের প্রাণ জাগিয়া উঠে । কবির কেকারব সেই বর্ষার গান ; কান তাহার মাধুর্য জানে না, মনই জানে। সেইজন্য মন তাহাতে অধিক মুগ্ধ হয়। মন তাহার সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকখানি পায়— সমস্ত মেঘাবৃত আকাশ, ছায়াবৃত অরণ্য, নীলিমাচ্ছন্ন গিরিশিখর, বিপুল মূঢ় প্রকৃতির অব্যক্ত অন্ধ আনন্দরাশি। বিরহিণীর বিরহবেদনার সঙ্গে কবির কেকারব এইজন্যই জড়িত। তাহা শ্রীতিমধুর বলিয়া পথিকবধূকে ব্যাকুল করে না, তাহ সমস্ত বর্ষার মর্মোদঘাটন করিয়া দেয়। নরনারীর প্রেমের মধ্যে একটি অত্যস্ত আদিম প্রাথমিক ভাব আছে ; তাহা বহিঃপ্রকৃতির অত্যন্ত নিকটবর্তী, তাহা জলস্থল-আকাশের গায়ে সংলগ্ন । ষড় ঋতু আপন পুষ্পপর্যায়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রেমকে নানা রঙে রাঙাইয়া দিয়া যায়। যাহতে পল্লবকে স্পন্দিত, নদীকে তরঙ্গিত, শস্যশীর্ষকে হিল্লোলিত করে, তাহ ইহাকেও অপূর্ব চাঞ্চল্যে আন্দোলিত করিতে থাকে। পূর্ণিমার কোটাল ইহাকে স্ফীত করে এবং সন্ধ্যাভ্রের রক্তিমায় ইহাকে লজ্জামণ্ডিত বধুবেশ পরাইয়া দেয়। এক-একটি ঋতু যখন আপন সোনার কাঠি লইয়া প্রেমকে স্পর্শ করে, তখন সে রোমাঞ্চকলেবরে না জাগিয়া থাকিতে পারে না । সে অরণ্যের পুষ্পপল্লবেরই মতো প্রকৃতির নিগৃঢ়স্পর্শাধান। সেইজন্য ৰেীবনাবেশবিধুর কালিদাস ছয় ঋতুর ছয় তারে নরনারীর প্রেম কী কী স্বরে বাজিতে থাকে তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন ; তিনি বুঝিয়াছেন, জগতে ঋতু-আবর্তনের সর্বপ্রধান কাজ প্রেম-জাগানো, ফুল-ফুটানে৷ প্রভৃতি অন্ত সমস্তই তাহার আনুষঙ্গিক। তাই যে কেকারব বৰ্ষাঋতুর নিখাদ স্বর তাহার আঘাত বিরহবেদনার ঠিক উপরে গিয়াই পড়ে। বিদ্যাপতি লিথিয়াছেন— মত্ত দাদুর ডাকে ডাহুকী ফাটি যাওত ছাতিয়া ।