পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৬২ রবীন্দ্র-রচনাবলী মৃতকেই বিস্মৃতিলোকে নির্বাসন দিয়া থাকেন, সেখানে কাহারও স্থানাভাব নাই । বিধাতা যদি বড়ো-বড়ো মৃতের আওতায় আমাদের মতো ছোটো-ছোটো জীবিতকে নিতান্ত বিমর্ষ-মলিন, নিতান্তই কোণঘেষা করিয়া রাখিবেন, তবে পৃথিবীকে এমন উজ্জল স্বন্দর করিলেন কেন, মানুষের হৃদয়টুকু মানুষের কাছে এমন একাস্তলোভনীয় হইল কী কারণে ? নীতিজ্ঞেরা আমাদিগকে নিন্দ করেন। বলেন, আমাদের জীবন বৃথা গেল । র্তাহারা আমাদিগকে তাড়না করিয়া বলিতেছেন—- উঠ, জাগো, কাজ করো, সময় নষ্ট করিয়ো না । কাজ না করিয়া অনেকে সময় নষ্ট করে সন্দেহ নাই ; কিন্তু কাজ করিয়া যাহারা সময় নষ্ট করে তাহার কাজও নষ্ট করে, সময়ও নষ্ট করে। তাহদের পদভারে পৃথিবী কম্পান্বিত এবং তাহদেরই সচেষ্টতার হাত হইতে অসহায় সংসারকে রক্ষা করিবার জন্য ভগবান বলিয়াছেন, ‘সম্ভবামি যুগে যুগে । জীবন বৃথা গেল। বৃথা যাইতে দাও । অধিকাংশ জীবনই বৃথা যাইবার জন্য হইয়াছে। এই পনেরো-আনা অনাবশ্যক জীবনই বিধাতার ঐশ্বর্য সপ্রমাণ করিতেছে। র্তাহার জীবনভাণ্ডারে যে দৈন্য নাই, ব্যর্থপ্রাণ আমরাই তাহার অগণ্য সাক্ষী । আমাদের অফুরান অজস্রতা, আমাদের অহেতুক বাহুল্য দেখিয়া বিধাতার মহিমা স্মরণ করে। বঁশি যেমন আপন শূন্যতার ভিতর দিয়া সংগীত প্রচার করে, আমরা সংসারের পনেরো-আনা আমাদের ব্যর্থতার দ্বারা বিধাতার গৌরব ঘোষণা করিতেছি। বুদ্ধ আমাদের জন্যই সংসার ত্যাগ করিয়াছেন, খৃস্ট আমাদের জন্য প্রাণ দিয়াছেন, ঋষিরা আমাদের জন্য তপস্যা করিয়াছেন, এবং সাধুরা আমাদের জন্য জাগ্রত রহিয়াছেন । জীবন বৃথা গেল। যাইতে দাও । কারণ, যাওয়া চাই। যাওয়াটাই একটা সার্থকতা। নদী চলিতেছে— তাহার সকল জলই আমাদের স্বানে এবং পানে এবং আমন-ধানের ক্ষেতে ব্যবহার হইয়া যায় না। তাহার অধিকাংশ জলই কেবল প্রবাহ রাখিতেছে । আর-কোনো কাজ না করিয়া কেবল প্রবাহরক্ষা করিবার একটা বৃহৎ সার্থকতা আছে। তাহার যে জল আমরা খাল কাটিয়া পুকুরে আনি তাহাতে স্বান করা চলে, কিন্তু তাহা গান করে না ; তাহার যে জল ঘটে করিয়া আনিয়া আমরা জালায় ভরিয়া রাখি তাহা পান করা চলে, কিন্তু তাহার উপরে আলোছায়ার উৎসব হয় না। উপকারকেই একমাত্র সাফল্য বলিয়া জ্ঞান করা কৃপণতার কথা, উদ্দেশুকেই একমাত্র পরিণাম বলিয়া গণ্য করা দীনতার পরিচয় ।