পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ 8 هون সাড়মংপর্বতবন্ধুর জম্বুকুঞ্জছায়ান্ধকার নববারিসিঞ্চিতযুীস্থগন্ধি একটি বিপুল পৃথিবী। হৃদয় সেই পৃথিবীর বনে বনে গ্রামে গ্রামে শৃঙ্গে শৃঙ্গে নদীর কূলে কুলে ফিরিতে ফিরিতে, অপরিচিত সুন্দরের পরিচয় লইতে লইতে, দীর্ঘ বিরহের শেষ মোক্ষস্থানে যাইবার জন্য মানসোংক হংসের ন্যায় উৎসুক হইয়া উঠে। মেঘদূত ছাড়া নববর্ষার কাব্য কোনো সাহিত্যে কোথাও নাই। ইহাতে বর্ষার সমস্ত অস্তবেদনা নিত্যকালের ভাষায় লিখিত হইয়া গেছে। প্রকৃতির সাংবংসরিক মেঘোংসবের অনির্বচনীয় কবিত্বগাথা মানবের ভাষায় বাধা পড়িয়াছে। পূর্বমেঘে বৃহং পৃথিবী আমাদের কল্পনার কাছে উদঘাটিত হইয়াছে। আমরা সম্পন্ন গৃহস্থটি হইয়া আরামে সস্তোষে অর্ধনিমীলিতলোচনে যে গৃহটুকুর মধ্যে বাস করিতেছিলামু, কালিদাসের মেঘ ‘আষাঢ়স্ত প্রথমদিবসে’ হঠাৎ আলিয়া আমাদিগকে সেখান হইতে ঘরছাড়া করিয়া দিল। আমাদের গোয়ালঘর-গোলাবাড়ির বহুদূরে যে আবর্তচঞ্চলা নর্মদা ভ্ৰকুটি রচনা করিয়া চলিয়াছে, যে চিত্ৰকূটের পাদকুঞ্জ প্রফুল্ল নবনীপে বিকশিত, উদয়নকথাকোবিদ গ্রামবৃদ্ধদের স্বারের নিকটে যে চৈত্যবট শুককাকলীতে মুখর, তাহাই আমাদের পরিচিত ক্ষুদ্র সংসারকে নিরস্ত করিয়া বিচিত্র সৌন্দর্যের চিরসত্যে উদ্ভাসিত হইয়া দেখা দিয়াছে । বিরহীর ব্যগ্রতাতেও কবি পথসংক্ষেপ করেন নাই। আষাঢ়ের নীলাভ মেঘচ্ছায়াবৃত নগ-নদী নগর-জনপদের উপর দিয়া রহিয়া রহিয়া ভাবাবিষ্ট অলসগমনে যাত্রা করিয়াছেন। যে তাহার মুগ্ধ নয়নকে অভ্যর্থনা করিয়া ডাকিয়াছে তিনি তাহাকে আর “না” বলিতে পারেন নাই। পাঠকের চিত্তকে কবি বিরহের বেগে বাহির করিয়াছেন, আবার পথের সৌন্দর্যে মন্থর করিয়া তুলিয়াছেন। যে চরম স্থানে মন ধাবিত হইতেছে তাহার সুদীর্ঘ পথটিও মনোহর, সে পথকে উপেক্ষা করা যায় না। বর্ষায় অভ্যস্ত পরিচিত সংসার হইতে বিক্ষিপ্ত হইয়া মন বাহিরের দিকে যাইতে চায়, পূর্বমেঘে কবি আমাদের সেই আকাজক্ষাকে উদবেলিত করিয়া তাহারই কলগান জাগাইয়াছেন, আমাদিগকে মেঘের সঙ্গী করিয়া অপরিচিত পৃথিবীর মাঝখান দিয়া লইয়া চলিয়াছেন। সে পৃথিবী অনাস্ত্ৰাতং পুষ্পম্, তাহা আমাদের প্রাত্যহিক ভোগের দ্বারা কিছুমাত্র মলিন হয় নাই, সে পৃথিবীতে আমাদের পরিচয়ের প্রাচীর দ্বারা কল্পনা কোনোখানে বাধা পায় না। যেমন ওই মেঘ তেমনি সেই পৃথিবী । আমার এই সুখদুঃখ-ক্লাস্তি-অবসাদের জীবন তাহাকে কোথাও স্পর্শ করে নাই। প্রৌঢ়বয়সের নিশ্চয়তা বেড়া দিয়া, ঘের দিয়া, তাহাকে নিজের বাস্তবাগানের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লয় নাই।