পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ 8ግ¢ স্বীকার করিলে, আকাশে নবনীলাঞ্জন মেযোদয়ের খাতিরে পড়া বন্ধ ও কাজ বন্ধ করিলে, দক্ষিণা হাওয়ার প্রতি একটুখানি শ্রদ্ধা রক্ষা করিয়া আইনের সমালোচনা বন্ধ রাখিলে, মানুষ জগৎচরাচরের মধ্যে একটা বেম্বরের মতো বাজিতে থাকে না । পাজিতে তিথিবিশেষে বেগুন শিম কুষ্মাগু নিষিদ্ধ আছে ; আরও কতকগুলি নিষেধ থাকা দরকার— কোন ঋতুতে খবরের কাগজ পড়া অবৈধ, কোন ঋতুতে আপিস কামাই না করা মহাপাতক, অরসিকের নিজবুদ্ধির উপর তাহ নির্ণয় করিবার ভার না দিয়া শাস্ত্রকারদের তাহা একেবারে বাধিয়া দেওয়া উচিত । বসন্তের দিনে-যে বিরহিণীর প্রাণ হা হা করে এ কথা আমরা প্রাচীন কাব্যেই পড়িয়াছি ; এখন এ কথা লিখিতে আমাদের সংকোচ বোধ হয়, পাছে লোকে হাসে । প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের মনের সম্পর্ক আমরা এমনি করিয়াই ছেদন করিয়াছি । বসন্তে সমস্ত বনে উপবনে ফুল ফুটিবার সময় উপস্থিত হয় ; তখন তাহদের প্রাণের অজস্রতা, বিকাশের উৎসব। তথন আত্মদানের উচ্ছ্বাসে তরুলতা পাগল হইয়া উঠে ; তখন তাহাদের হিসাবের বোধমাত্র থাকে না— যেখানে দুটা ফল ধরিবে সেখানে পচিশটা মুকুল ধরাইয়া বসে। মানুষই কি কেবল এই অজস্রতার স্রোত রোধ করিবে ? সে আপনাকে ফুটাইবে না, ফলাইবে না, দান করিতে চাহিবে না, কেবলই কি ঘর নিকাইবে, বাসন মাজিবে— ও যাহাঁদের সে বালাই নাই তাহারা বেলা চারটে পর্যন্ত পশমের গলাবন্ধ বুনিবে ? আমরা কি এতই একান্ত মানুষ? আমরা কি বসন্তের নিগৃঢ়রসসঞ্চার-বিকশিত তরুলতাপুষ্পপল্লবের কেহই নই? তাহারা যে আমাদের ঘরের আঙিনাকে ছায়ায় ঢাকিয়া, গন্ধে ভরিয়া, বাহু দিয়া ঘেরিয়া দাড়াইয়া আছে, তাহারা কি আমাদের এতই পর যে তাহারা য’ন ফুলে ফুটিয়া উঠিবে আমরা তখন চাপকান পরিয়া আপিসে যাইব— কোনো অনির্বচনীয় বেদনায় আমাদের হৃৎপিণ্ড তরুপল্লবের মতে কঁাপিয়া উঠিবে না ? আমি তো আজ গাছপালার সঙ্গে বহুপ্রাচীন কালের আত্মীয়তা স্বীকার করিব । ব্যস্ত হইয়া কাজ করিয়া বেড়ানোই যে জীবনের অদ্বিতীয় সার্থকতা এ কথা আজ আমি কিছুতেই মানিব না। আজ আমাদের সেই যুগান্তরের বড়োদিদি বনলক্ষ্মীর ঘরে ভাইফোটার নিমন্ত্রণ। সেখানে আজ তরুলতার সঙ্গে নিতান্ত ঘরের লোকের মতো মিশিতে হইবে— আজি ছায়ায় পড়িয়া সমস্ত দিন কাটিবে, মাটিকে আজ দুই হাত ছড়াইয়া আঁকড়াইয়া ধরিতে হইবে, বসন্তের হাওয়া যখন বহিবে তখন তাহার আনন্দকে যেন আমার বুকের পাজরগুলার মধ্য দিয়া অনায়াসে হু হু করিয়া বহিয়া যাইতে দিই— সেখানে সে যেন এমনতরো কোনো ধ্বনি না জাগাইয়া তোলে