পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8bré রবীন্দ্র-রচনাবলী এখান হইতে ডাকগাড়িতে যাইতে হইবে । ডাকগাড়ি মানুষে টানিয়া লইয়া যায়। একে কি আর গাড়ি বলে ? চারটে চাকার উপর একটা ছোটো খাচা মাত্র। সর্বপ্রথমে গিরিধি ডাকবাংলায় গিয়া স্নানাহার করিয়া লওয়া গেল। ডাকবাংলার যতদূরে চাই, ঘাসের চিহ্ন নাই। মাঝে মাঝে গোটাকতক গাছ আছে। চারি দিকে যেন রাঙামাটির ঢেউ উঠিয়াছে। একটা রোগী টাটু ঘোড়া গাছের তলায় বাধা, চারি দিকে চাহিয়া কী যে খাইবে তাহা ভাবিয়া পাইতেছে না, কোনো কাজ না থাকাতে গাছের গুড়িতে গা ঘষিয়া গা চুলকাইতেছে । আর-একটা গাছে একটা ছাগল লম্বা দড়িতে বাধা, সে বিস্তর গবেষণায় শাকের মতো একটু একটু সবুজ উদ্ভিদপদার্থ পটু পটু করিয়া ছিড়িতেছে। এখান হইতে যাত্রা করা গেল। পাহাড়ে রাস্তা । সম্মুখে পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। শুষ্ক শূন্ত স্ববিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে সাপের মতো আঁকিয়া-বাকিয়া ছায়াহীন সুদীর্ঘ পথ রৌদ্রে শুইয়া আছে। একবার কষ্টেস্বষ্টে টানিয়া ঠেলিয়া গাড়ি চড়াও রাস্তার উপর তুলিতেছে, একবার গাড়ি গড় গড় করিয়া দ্রুতবেগে ঢালু রাস্তায় নামিয়া যাইতেছে। ক্রমে চলিতে চলিতে আশেপাশে পাহাড় দেখা দিতে লাগিল । লম্বা লম্বা সরু সরু শালগাছ । উইয়ের টিবি। কাটা গাছের গুড়ি । স্থানে স্থানে এক-একটা পাহাড় আগাগোড়া কেবল দীর্ঘ সরু পত্রলেশশূন্ত গাছে আচ্ছন্ন। উপবাসী গাছগুলো তাহদের শুষ্ক শীর্ণ অস্থিময় দীর্ঘ আণ্ডল আকাশের দিকে তুলিয়া আছে ; এই পাহাড়গুলাকে দেখিলে মনে হয় যেন ইহারা সহস্র তীরে বিদ্ধ হইয়াছে, যেন ভীষ্মের শরশয্যা হইয়াছে । আকাশে মেঘ করিয়া আসিয়া অল্প অল্প বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে। কুলিরা গাড়ি টানিতে টানিতে মাঝে মাঝে বিকট চীংকার করিয়া উঠিতেছে। মাঝে মাঝে পথের তুড়িতে হু চট খাইয়া গাড়িটা অত্যস্ত চমকিয়া উঠিতেছে। মাঝের এক জায়গায় পথ অবসান হইয়া বিস্তৃত বালুকাশয্যায় একটি ক্ষীণ নদীর রেখা দেখা দিল। নদীর নাম জিজ্ঞাসা করাতে কুলির কহিল ‘বড়াকর নদী’। টানাটানি করিয়া গাড়ি এই নদীর উপর দিয়া পার করিয়া আবার রাস্তায় তুলিল। রাস্তার দুই পাশে ডোবাতে জল দাড়াইয়াছে ; তাহাতে চার-পাচটা মহিষ পরস্পরের গায়ে মাথা রাখিয়া অর্ধেক শরীর ডুবাইয়া আছে, পরম আলস্যভরে আমাদের দিকে এক-একবার কটাক্ষপাত করিতেছে মাত্র । যখন সন্ধ্য আসিল, আমরা গাড়ি হইতে নামিয়া হাটিয়া চলিলাম। অদূরে দুইটি পাহাড় দেখা যাইতেছে,তাহার মধ্য দিয়া উঠিয়া নামিয়া পথ গিয়াছে । ৰেখানেই চাহি চারি দিকে লোক নাই, লোকালয় নাই, শস্ত নাই, চযা মাঠ নাই ; চারি দিকে উচুনিচু পৃথিবী নিস্তন্ধ নিঃশব্দ কঠিন সমূত্রের মতো ধৃ ধূ করিতেছে। দিগদিগন্তরের উপরে