পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ένιν রবীন্দ্র-রচনাবলী অধীর হইয়া জলের দিকে চলিয়া যাইতেছে, আবার কী মনে করিয়া আত্মসম্বরণপূর্বক তীরের দিকে ফিরিয়া আসিতেছে। গাড়ি হইতে মাটিতে পা দিতে না দিতে ঝণকে ঝণকে মাঝি আমাদের উপরে আসিয়া পড়িল। এ বলে আমার নৌকায়’, ও বলে আমার নৌকায় ; এইরূপে মাঝির তরঙ্গে আমাদের ততুর তরী একবার দক্ষিণে, একবার বামে একবার মাঝখানে আবর্তের মধ্যে ঘূর্ণিত হইতে লাগিল। অবশেষে অবস্থার তোড়ে, পূর্বজন্মের বিশেষ একটা কী কর্মফলে বিশেষ একটা নৌকার মধ্যে গিয়া পড়িলাম। পাল তুলিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিল। গঙ্গায় আজ কিছু বেশি ঢেউ দিয়াছে, বাতাসও উঠিয়াছে। এখন জোয়ার। ছোটো ছোটো নৌকাগুলি আজ পাল ঝুলাইয়া ভারি তেজে চলিয়াছে ; আপনার দেমাকে আপনি কাত হইয়া পড়ে বা । একটা মস্ত স্ট্রীমার দুই পাশে দুই লৌহতরী লইয়া আশপাশের ছোটোখাটো নৌকাগুলির প্রতি নিতান্ত অবজ্ঞাভরে লোহার নাকটা আকাশে তুলিয়া গা গা শব্দ করিতে করিতে সধুমনিশ্বাসে আমাদের দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। মনোযোগ দিয়া দেখি আমাদেরই জাহাজ—“রাখ, রাখ, থাম থাম!” মাঝি কহিল, “মহাশয় ভয় করিবেন না, এমন ঢের-বার জাহাজ ধরিয়াছি।” বলা বাহুল্য এবারও ধরিল । জাহাজের উপর হইতে একটা সিড়ি নামাইয়া দিল । ছেলেদের প্রথমে উঠানো গেল, তাহার পর আমার ভাজ-ঠাকুরানী যখন বহুকষ্টে তাহার স্থলপদ্ম-পা-দুখানি জাহাজের উপর তুলিলেন তখন আমরাও মধুকরের মতে তাহারই পশ্চাতে উপরে উঠিয়া পড়িলাম । २ যদিও স্রোত এবং বাতাস প্রতিকূলে ছিল, তথাপি আমাদের এই গজবর উর্ধ্বশুণ্ডে বৃংহিতধ্বনি করিতে করিতে গজেন্দ্রগমনের মনোহারিতা উপেক্ষা করিয়া চত্বারিংশৎতুরঙ্গ-বেগে ছুটিতে লাগিল। আমরা ছয় জন এবং জাহাজের বৃদ্ধ কর্তা বাৰু এই সাত জনে মিলিয়া জাহাজের কামরার সম্মুখে খানিকট খোলা জায়গায় কেদারা লইয়া বসিলাম। আমাদের মাথার উপরে কেবল একটি ছাত আছে। সন্মুখ হইতে হু হু করিয়া বাতাস আসিয়া কানের কাছে সে সে করিতে লাগিল, জামার মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাকে অকস্মাৎ ফুলাইয়া তুলিয়া ফর ফর আওয়াজ করিতে থাকিল এবং আমার ভ্রাতৃজায়ার স্বদীর্ঘ স্থসংযত চুলগুলিকে বার বার অবাধ্যতাচরণে উৎসাহিত করিয়া তুলিল। তাহারা নাকি জাত-সাপিনীর বংশ, এই নিমিত্ত বিদ্রোহী হইয়া বেণী-বন্ধন এড়াইয়া পূজনীয়া ঠাকুরানীর নাসাবিবর ও মুখরদ্ধের মধ্যে পথ অনুসন্ধান করিতে লাগিল ; আবার আর-কতকগুলি উর্ধ্বমুখ হইয়া জাম্ফালন করিতে করিতে