পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিচিত্র প্রবন্ধ 8brS মাথার উপর রীতিমত নাগলোকের উৎসব বাধাইয়া দিল ; কেরল বেণী-নামক অজগর সাপট শত বন্ধনে বদ্ধ হইয়া, শত শেলে বিদ্ধ হইয়া, শত পাক পাকাইয়া নিজীবভাবে খোপা আকারে ঘাড়ের কাছে কুগুলী পাকাইয়া রহিল। অবশেষে কখন এক সময়ে দাদা বাধের দিকে মাথা নেওয়াইয়া ঘুমাইতে লাগিলেন, বউঠাকুরানীও চুলের দৌরাত্ম্য বিশ্বত হইয়া চৌকির উপরে চক্ষু মুদিলেন। - জাহাজ অবিশ্রাম চলিতেছে। ঢেউগুলি চারি দিকে লাফাইয়া উঠিতেছে— তাহাদের মধ্যে এক-একটা সকলকে ছাড়াইয়া শুভ্র ফণা ধরিয়া হঠাৎ জাহাজের ডেকের উপর যেন ছোবল মারিতে আসিতেছে ; গর্জন করিতেছে, পশ্চাতের সঙ্গীদের মাথা তুলিয়া ডাকিতেছে ; স্পর্ধা করিয়া ফুলিয়া-ফুলিয়া চলিতেছে— মাথার উপরে সূর্যকিরণ দীপ্তিমান চোখের মতো জলিতেছে— নৌকাগুলাকে কাত করিয়া ধরিয়া তাহার মধ্যে কী আছে দেখিবার জন্য উচু হইয়া দাড়াইয়া উঠিতেছে ; মুহূর্তের মধ্যে কৌতুহল পরিতৃপ্ত করিয়া নৌকাটাকে ঝাকানি দিয়া আবার কোথায় তাহারা চলিয়া যাইতেছে। আপিসের ছিপছিপে পানসিগুলি পালটুকু ফুলাইয় আপনার মধুর গতির আনন্দ আপনি যেন উপভোগ করিতে করিতে চলিতেছে ; তাহারা মহৎ মাস্তুল-কিরাটা জাহাজের গাম্ভীর্ষ উপেক্ষা করে, স্ট্রীমারের বিষাণধ্বনিও মান্ত করে না, বরঞ্চ বড়ো বড়ো জাহাজের মুখের উপর পাল দুলাইয়া হাসিয়া রঙ্গ করিয়া চলিয়া যায় ; জাহাজও তাহাতে বড়ো অপমান জ্ঞান করে না । কিন্তু গাধাবোটের ব্যবহার স্বতন্ত্র, তাহীদের নড়িতে তিন ঘণ্টা, তাহদের চেহারাটা নিতান্ত স্থূলবুদ্ধির মতে, তাহারা নিজে নড়িতে অসমর্থ হইয়া অবশেষে জাহাজকে সরিতে বলে— তাহারা গায়ের কাছে আসিয়া পড়িলে সেই স্পর্ধা অসহ বোধ হয়। এক সময় শুনা গেল আমাদের জাহাজের কাপ্তেন নাই। জাহাজ ছাড়িবার পূর্বরাত্রেই সে গা-ঢাকা দিয়াছে। শুনিয়া আমার ভাজ-ঠাকুরানীর ঘুমের ঘোর একেবারে ছাড়িয়া গেল ; র্তাহার সহসা মনে হইল যে, কাপ্তেন যখন নাই তখন নোঙরের অচলশরণ অবলম্বন করাই শ্রেয়। দাদা বলিলেন, তাহার আবগুক নাই, কাপ্তেনের নিচেকার লোকের কাপ্তেনের চেয়ে কোনো অংশে নূ্যন নহে। কর্তাবাবুরও সেইরূপ মত। বাকি সকলে চুপ করিয়া রছিল, কিন্তু তাহদের মনের ভিতরটা আর কিছুতেই প্রসন্ন হইল না। তবে, দেখিলাম নাকি জাহাজটা সত্য সত্যই চলিতেছে, আর ইাকডাকেও কাপ্তেনের অভাব সম্পূর্ণ ঢাকা পড়িয়াছে, তাই চুপ মারিয়া রছিলাম। হঠাৎ জাহাজের হৃদয়ের ধুক ধুক শৰ বন্ধ হইয়া গেল ; কল চলিতেছে না ; ‘নোঙর ফেলো ‘নোঙর ফেলো বলিয়া শৰ উঠিল— নোঙর ফেলা হইল। কলের এক জায়গায় কোথায় একটা জোড়