পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8న o রবীন্দ্র-রচনাবলী খুলিয়া গেছে, সেটা মেরামত করিলে তবে জাহাজ চলিবে। মেরামত আরম্ভ হইল। এখন বেলা সাড়ে দশটা, দেড়টার পূর্বে মেরামত সমাপ্ত হইবার সম্ভাবনা নাই। বসিয়া বসিয়া গঙ্গাতীরের শোভা দেখিতে লাগিলাম। শাস্তিপুরের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া গঙ্গাতীরের যেমন শোভা এমন আর কোথায় আছে। গাছপালা ছায়া কুটির— নয়নের আনন্দ অবিরল সারি সারি দুই ধারে বরাবর চলিয়াছে, কোথাও বিরাম নাই। কোথাও বা তটভূমি সবুজ ঘাসে আচ্ছন্ন হইয়া গঙ্গার কোলে আসিয়া গড়াইয়া পড়িয়াছে ; কোথাও বা একেবারে নদীর জল পর্যস্ত ঘন গাছপালা লতাজালে জড়িত হইয়া ঝু কিয়া আসিয়াছে, জলের উপর তাহদের ছায়া অবিশ্রাম দুলিতেছে ; কতকগুলি সূর্যকিরণ সেই ছায়ার মাঝে মাঝে ঝিকমিক্‌ করিতেছে, আর বাকি কতকগুলি— গাছপালার কম্পমান কচি মন্থণ সবুজ পাতার উপরে চিকচিক্‌ করিয়া উঠিতেছে। একটা বা নৌকা তাহার কাছাকাছি গাছের গুড়ির সঙ্গে বাধা রহিয়াছে, সে সেই ছায়ার নীচে, অবিশ্রাম জলের কুলকুল শব্দে মৃদু মৃদু দোল পাইয়। বড়ো আরামের ঘুম ঘুমাইতেছে। তাহার আর-এক পাশে বড়ো বড়ো গাছের অতি ঘনচ্ছায়ার মধ্য দিয়া ভাঙা ভাঙা বঁকা একটা পদচিহ্নের পথ জল পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে। সেই পথ দিয়া গ্রামের মেয়েরা কলসী কাখে করিয়া জল লইতে নামিতেছে, ছেলেরা কাদার উপরে পড়িয়া জল ছোড়াছড়ি করিয়া সাতার কাটিয়া ভারি মাতামাতি করিতেছে। প্রাচীন ভাঙা ঘাটগুলির কী শোভা ! মাতুষেরা যে এ ঘাট বাধিয়াছে তাহা একরকম ভুলিয়া যাইতে হয় ; এও যেন গাছপালার মতো গঙ্গাতীরের নিজস্ব । ইহার বড়ো বড়ো ফাটলের মধ্য দিয়া অশথগাছ উঠিয়াছে, ধাপগুলির ইটের ফণক দিয়া ঘাস গজাইতেছে— বহু বংসরের বর্ষার জলধারায় গায়ের উপরে শেয়ালা পড়িয়াছে— এবং তাহার রঙ চারি দিকের শুiমল গাছপালার রঙের সহিত কেমন সহজে মিশিয়া গেছে। মানুষের কাজ ফুরাইলে প্রকৃতি নিজের হাতে সেটা সংশোধন করিয়া দিয়াছেন ; তুলি ধরিয়া এখানে ওখানে নিজের রঙ লাগাইয়া দিয়াছেন। অত্যন্ত কঠিন সগর্ব ধবধবে পারিপাট্য নষ্ট করিয়া, ভাঙাচোরা বিশৃঙ্খল মাধুর্য স্থাপন করিয়াছেন। গ্রামের যে-সকল ছেলেমেয়েরা নাহিতে বা জল লইতে আসে তাহাদের সকলেরই সঙ্গে ইহার যেন একটা-কিছু সম্পর্ক পাতানে আছে— কেহ ইহার নাৎনি, কেহ ইহার ভাগনে, কেহ ইহার মা-মাসি। তাহাদের দাদামহাশয় ও দিদিমারা যখন এতটুকু ছিল তখন ইহারই ধাপে বসিয়া খেলা করিয়াছে, বর্ষার দিনে পিছল খাইয়া পড়িয়া গিয়াছে। আর সেই-ষে যাত্রাওয়ালা বিখ্যাত গায়ক অন্ধ খ্ৰীনিবাস সন্ধ্যাবেলায় ইহার পইঠার উপর বসিয়া বেহালা বাজাইয়া