পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৯২ রবীন্দ্র-রচনাবলী নারিকেলের গাছগুলি, মন্দিরের চুড়া, আকাশের পটে আঁকা নিন্তব্ধ গাছের মাথাগুলি, স্থির জলের উপরে লাবণ্যের মতো সন্ধ্যার আভা— স্বমধুর বিরাম, নির্বাপিত কলরব, অগাধ শাস্তি— সে-সমস্ত মিলিয়া নন্দনের একখানি মরীচিকার মতো, ছায়াপথের পরপরবর্তী স্থদুর শাস্তিনিকেতনের একখানি ছবির মতো পশ্চিমদিগন্তের ধারটুকুতে আঁকা দেখা যায়। ক্রমে সন্ধ্যার আলো মিলাইয়া যায়, বনের মধ্যে এ দিকে ও দিকে এক-একটি করিয়া প্রদীপ জ্বলিয়া উঠে, সহসা দক্ষিণের দিক হইতে একটা বাতাস উঠিতে থাকে, পাতা ঝরঝর করিয়া কঁাপিয়া উঠে, অন্ধকারে বেগবতী নদী বহিয়া যায়, কুলের উপরে অবিশ্রাম তরঙ্গ-আঘাতে ছলছল করিয়া শব্দ হইতে থাকে— আর-কিছু ভালো দেখা যায় না, শোনা যায় না, কেবল ঝিঝি পোকার শব্দ উঠে, আর জোনাকিগুলি অন্ধকারে জলিতে নিবিতে থাকে। আরও রাত্রি হয়। ক্রমে কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর চাদ ঘোর অন্ধকার অশথ গাছের মাথার উপর দিয়া ধীরে ধীরে আকাশে উঠিতে থাকে। নিম্নে বনের শ্রেণীবদ্ধ অন্ধকার, আর উপরে মান চন্দ্রের আভা । খানিকট আলো অন্ধকার-ঢালা গঙ্গার মাঝখানে একটা জায়গায় পড়িয়া তরঙ্গে তরঙ্গে ভাঙিয়া ভাঙিয়া যায়। ও পারের অস্পষ্ট বনরেখার উপর আর-খানিকটা আলো পড়ে, সেইটুকু আলোতে ভালো করিয়া কিছুই দেখা যায় না ; কেবল ও পারের স্বদুরতা ও অক্ষুটতাকে মধুর রহস্যময় করিয়া তোলে। এ পারে নিদ্রার রাজ্য আর ও পারে স্বপ্নের দেশ বলিয়া মনে হইতে থাকে। এই যে-সব গঙ্গার ছবি আমার মনে উঠিতেছে, এ কি সমস্তই এইবারকার স্টীমারযাত্রার ফল ? তাহা নহে। এ-সব কতদিনকার কত ছবি, মনের মধ্যে আঁকা রহিয়াছে। ইহারা বড়ো সুখের ছবি, আজ ইহাদের চারি দিকে আশ্রজলের স্ফটিক দিয়া বাধাইয়া রাখিয়াছি। এমনতরো শোভা আর এ জন্মে দেখিতে পাইব না। মেরামত শেষ হইয়া গেছে ; যাত্রীদের স্নানাহার হইয়াছে, বিস্তর কোলাহল করিয়া নোঙর তোলা হইতেছে। জাহাজ ছাড়া হইল। বামে মুচিখোলার নবাবের প্রকাও খাচা । ডান দিকে শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেন। যত দক্ষিণে যাইতে লাগিলাম, গঙ্গা ততই চওড়া হইতে লাগিল। বেলা দুটাে-তিনটের সময় ফলমূল সেবন করিয়া সন্ধ্যাবেলায় কোথায় গিয়া থামা যাইবে তাহারই আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া গেল। আমাদের দক্ষিণে বামে নিশান উড়াইয়া অনেক জাহাজ গেল আসিল— তাহদের সগর্ব গতি দেখিয়া আমাদের উৎসাহ আরও বাড়িয়া উঠিল। বাতাস যদিও উলটা বহিতেছে, কিন্তু শ্রোত আমাদের অমুকুল। আমাদের উৎসাহের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের বেগও অনেক বাড়িয়াছে। জাহাজ বেশ দুলিতে লাগিল। দূর হইতে দেখিতেছি এক