পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se SAVO যদি চলতে পারি তা হলে দিগন্তে দিগন্তে সোনার সিংহদ্বার খুলে যাবে, শুভ্রতার ভিতর-মহলে প্রবেশ করব। আর, যদি না পারি, তবে এই বাতায়নের ধারে বসে কোন-এক অনেক দূরের জন্যে দীর্ঘনিশ্বাস উঠতে থাকবে, কেবলই দিনের পর দিন, রাত্রির পর রাত্রি, অজ্ঞাত বনের পথশ্রেণী আর অনাঘাত ফুলের গন্ধের জন্যে বুকের ভিতরটা কেঁদে কেঁদে ঝুরে ঝুরে মরবে। আর বসন্তকালে এই-যে সমস্ত বন রঙে রঙিন, এখন আমি তোমাকে দেখতে পাই কানে কুণ্ডল, হাতে অঙ্গদ, গায়ে বসন্তী রঙের উত্তরীয়, হাতে অশোকের মঞ্জরী, তানে তানে তোমার বীণার সাব-কটি সোনার তার উতলা । রাজা। এত বিচিত্ররূপ দেখছ, তবে কেন সব বাদ দিয়ে কেবল একটি বিশেষ মূর্তি দেখতে চাচ্ছি। সেটা যদি তোমার মনের মতো না হয় তবে তো সমস্ত গেল । s সুদৰ্শনা । মনের মতো হবে নিশ্চয় জানি । রাজা । মন যদি তার মতো হয় তবেই সে মনের মতো হবে । আগে তাই হােক । সুদৰ্শনা। সত্য বলছি, এই অন্ধকারের মধ্যে যখন তোমাকে দেখতে না পাই অথচ তুমি আছ বলে জানি, তখন এক-একবার কেমন-একটা ভয়ে আমার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে ! রাজা । সে ভয়ে দোষ কী । প্রেমের মধ্যে ভয় না থাকলে তার রস হালকা হয়ে যায়। । আচ্ছা, আমি জিজ্ঞাসা করি, এই অন্ধকারের মধ্যে তুমি আমাকে দেখতে পাও ? রাজা । পাই বৈকি । সুদৰ্শনা । কেমন করে দেখতে পাও । আচ্ছা, কী দেখ । রাজা। দেখতে পাই, যেন অনন্ত আকাশের অন্ধকার আমার আনন্দের টানে ঘুরতে ঘুরতে কত নক্ষত্রের আলো টেনে নিয়ে এসে একটি জায়গায় রূপ ধরে দাড়িয়েছে। তার মধ্যে কত যুগের ধ্যান, কত আকাশের আবেগ, কত ঋতুর উপহার। সুদৰ্শনা । আমার এত রূপ ! তোমার কাছে যখন শুনি বুক ভরে ওঠে । কিন্তু ভালো করে প্রত্যয় হয় না ; নিজের মধ্যে তো দেখতে পাই নে । রাজা । নিজের আয়নায় দেখা যায় না- ছোটো হয়ে যায় । আমার চিত্তের মধ্যে যদি দেখতে পাও তো দেখবে, সে কত বড়ো ! আমার হৃদয়ে তুমি যে আমার দ্বিতীয়, তুমি সেখানে কি শুধু তুমি ! সুদৰ্শনা । বলো বলো, এমনি করে বলে ! আমার কাছে তোমার কথা গানের মতো বোধ হচ্ছেযেন অনাদিকালের গান, যেন জন্ম-জন্মান্তর শুনে এসেছি। সে কি তুমিই শুনিয়েছ, আর আমাকেই শুনিয়েছ। না, যাকে শুনিয়েছ। সে আমার চেয়ে অনেক বড়ো, অনেক সুন্দর ; তোমার গানে সেই অলোকসুন্দরীকে দেখতে পাই- সে কি আমার মধ্যে, না তোমার মধ্যে । তুমি আমাকে যেমন করে দেখছি তাই একবার এক নিমেষের জন্য আমাকে দেখিয়ে দাও-না । তোমার কাছে অন্ধকার বলে কি কিছুই নেই। সেইজন্যেই তো তোমাকে কেমন আমার ভয় করে। এই-যে কঠিন কালো লোহার মতো অন্ধকার, যা আমার উপর ঘুমের মতো, মূৰ্ছার মতো, মৃত্যুর মতো, তোমার দিকে তার কিছুই নেই! তবে এ জায়গায় তোমার সঙ্গে আমি কেমন করে মিলব । না না, হবে না মিলন, হবে না । এখানে নয়, এখানে নয় । যেখানে আমি গাছপালা পশুপাখি মাটিপাথর সমস্ত দেখছি সেইখানেই তোমাকে দেখব । রাজা । আচ্ছা, দেখো, কিন্তু তোমাকে নিজে চিনে নিতে হবে ; কেউ তোমাকে বলে দেবে নাআর বলে দিলেই বা বিশ্বাস কী ? - সুদৰ্শনা । আমি চিনে নেব, চিনে নেব, লক্ষ লোকের মধ্যে চিনে নেব । ভুল হবে না । রাজা । আজ বসন্তপূর্ণিমার উৎসবে তুমি তোমার প্রাসাদের শিখরের উপরে দাড়িয়ে- চেয়ে দেখৈী- আমার বাগানে সহস্ৰ লোকের মধ্যে আমাকে দেখবার চেষ্টা কোরো । সুদৰ্শনা। তাদের মধ্যে দেখা দেবে তো ? রাজা । বার বার করে সকল দিক থেকেই দেখা দেব । সুরঙ্গমা !