পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 9ܬܓ দিকে থেকে থেকে তৃপ্ত কণ্ঠের রব ওঠে, জয় হােক রানীমার । অবশেষে উৎসবের মেয়াদ ফুরোল, বাড়ি হয়ে গেল খালি । কেবল ছেড়া কলাপাতা ও সরা-খুর-ভঁাড়ের ভগ্নাবশেষের উপর কাক-কুকুরের কলরবমুখর উত্তরকাণ্ড চলছে। ফরাসেরা সিঁড়ি খাটিয়ে লণ্ঠন খুলে নিল, চাঁদোয়া নামাল, ঝাড়ের টুকরো বাতি ও শোলার ফুলের ঝালরগুলো নিয়ে পাড়ার ছেলেরা কড়াকড়ি বাধিয়ে দিল । সেই ভিড়ের মধ্যে মাঝে মাঝে চড়ের আওয়াজ ও চীৎকার কান্না যেন তারস্বরের হাউইয়ের মতো আকাশ ফুড়ে উঠছে। অন্তঃপুরের প্রাঙ্গণ থেকে উচ্ছিষ্ট ভাত তরকারির গন্ধে বাতাস অন্নগন্ধী ; সেখানে সর্বত্র ক্লান্তি, অবসাদ ও মলিনতা । এই শূন্যতা অসহ্য হয়ে উঠল। যখন মুকুন্দলাল আজও ফিরলেন না। নাগাল পাবার উপায় নেই বলেই নন্দরানীর ধৈর্যের বঁাধ হঠাৎ ফেটে খান খান হয়ে গেল । দেওয়ানজিকে ডাকিয়ে পর্দার আড়াল থেকে বললেন, “কর্তাকে বলবেন, বৃন্দাবনে মা’র কাছে আমাকে এখনই যেতে হচ্ছে। তার শরীর ভালো নেই।” দেওয়ানজি কিছুক্ষণ টাকে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “কর্তাকে জানিয়ে গেলেই ভালো হত মােঠাকরুন। আজকালের মধ্যে বাড়ি ফিরবেন খবর পেয়েছি।” “না, দেরি করতে পারব না ।” নন্দরানীও খবর পেয়েছেন। আজকালের মধ্যেই ফেরবার কথা । সেইজন্যেই যাবার এত তাড়া । নিশ্চয় জানেন, অল্প একটু কান্নাকাটি-সাধ্যসাধনাতেই সব শোধ হয়ে যাবে। প্রতিবারই এমনি হয়েছে। উপযুক্ত শাস্তি অসমাপ্তই থাকে । এবারে তা কিছুতেই চলবে না । তাই দণ্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েই দণ্ডদাতাকে পালাতে হচ্ছে। বিদায়ের ঠিক পূর্বমুহুর্তে পা সরতে চায় না- শোবার খাটের উপর উপুড় হয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কান্না । কিন্তু যাওয়া বন্ধ হল না । তখন কার্তিক মাসের বেলা দুটাে। রৌদ্রে বাতাস আতপ্ত । রাস্তার ধারের সিসুতরুশ্রেণীর মর্মরের সঙ্গে মিশে কাচিৎ গলাভাঙা কোকিলের ডাক আসছে। যে রাস্তা দিয়ে পালকি চলেছে সেখান থেকে । কঁচা ধানের খেতের পরপ্রান্তে নদী দেখা যায় । নন্দরানী থাকতে পারলেন না, পালকির দরজা ফাক করে সে দিকে চেয়ে দেখলেন। ও পারের চরে বজরা বাধা আছে, চোখে পড়ল। মাত্তলের উপর নিশেন উড়ছে। দূর থেকে মনে হল, বজরার ছাতের উপর চিরপরিচিত গুপি হরকরা বসে ; তার পাগড়ির তকমার উপর সূর্যের আলো ঝকমক করছে। সবলে পালকির দরজা বন্ধ করে দিলেন, বুকের ভিতরটা পাথর হয়ে গেল । وا মুকুন্দলাল, যেন মাস্তুল-ভাঙা, পাল-ছেড়া, টােল-খাওয়া, তুফানে আছািড়-লগা জাহাজ, সসংকোচে বন্দরে এসে ভিড়লেন। অপরাধের বোঝায় বুক ভারী। প্রমোদের স্মৃতিটা যেন অতিভোজনের পরের উচ্ছিষ্ট্রের মতো মনটাকে বিতৃষ্ণায় ভরে দিয়েছে। যারা ছিল তার এই আমোদের উৎসাহদাতা উদযোগকর্তা, তারা যদি সামনে থাকত তা হলে তাদের ধরে চাবুক কষিয়ে দিতে পারতেন । মনে মনে পণ করছেন আর কখনো এমন হতে দেবেন না। তার আলুথালু চুল, রক্তবর্ণ চোখ আর মুখের অতিশুষ্ক ভাব দেখে প্রথমটা কেউ সাহস করে কত্রীঠাকরুনের খবরটা দিতে পারলে না, মুকুন্দলাল ভয়ে ভয়ে অন্তঃপুরে গেলেন । 'বড়োবউ মাপ করে- অপরাধ করেছি, আর কখনো এমন হবে না।” এই কথা মনে মনে বলতে বলতে শোবার ঘরের দরজার কাছে একটুখানি থমকে দাড়িয়ে আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলেন । মনে মনে নিশ্চয় স্থির করেছিলেন যে, অভিমানিনী বিছানায় পড়ে আছেন। একেবারে পায়ের কাছে গিয়ে পড়বেন এই ভেবে ঘরে ঢুকেই দেখলেন ঘর শূন্য । বুকের ভিতরটা দমে গেল। শোবার ঘরে বিছানায় নন্দরানীকে যদি দেখতেন তবে বুঝতেন যে, অপরাধ ক্ষমা করবার জন্যে মানিনী অর্ধেক রাস্তা এগিয়ে আছেন। কিন্তু বড়োবউ যখন শোবার ঘরে নেই তখন মুকুন্দলাল বুঝলেন, তার প্রায়শ্চিত্তটা হবে দীর্ঘ এবং কঠিন । হয়তো আজ রাত পর্যন্ত