পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOOO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী অপেক্ষা করতে হবে, কিংবা হবে। আরো দেরি । কিন্তু এতক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকা তার পক্ষে অসম্ভব । সম্পূর্ণ শান্তি এখনই মাথা পেতে নিয়ে ক্ষমা আদায় করবেন, নইলে জলগ্ৰহণ করবেন না। বেলা হয়েছে, এখনো স্নানাহার হয় নি, এ দেখে কি সাধবী থাকতে পারবেন ? শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন, প্যারী দাসী বারান্দার এক কোণে মাথায় ঘোমটা দিয়ে দাড়িয়ে । জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর বড়োবউমা কোথায় ?” সে বললে, “তিনি তার মাকে দেখতে পরশুদিন বৃন্দাবনে গেছেন।” ভালো যেন বুঝতে পারলেন না, রুদ্ধকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় গেছেন ?” “বৃন্দাবনে । মায়ের অসুখ ।” মুকুন্দলাল একবার বারান্দার রেলিং চেপে ধরে দাঁড়ালেন। তার পরে দ্রুতপদে বাইরে বৈঠকখানায় গিয়ে একা বসে রইলেন । একটি কথা কইলেন না । কাছে আসতে কারও সাহস হয় না । দেওয়ানজি এসে ভয়ে ভয়ে বললেন, “মিঠাকরুনকে আনতে লোক পাঠিয়ে দিই ?” কোনো কথা না বলে কেবল আঙুল নেড়ে নিষেধ করলেন । দেওয়ানজি চলে গেলে রাধু খানসামাকে ডেকে বললেন, “ব্ৰান্ডি লে আও ।” বাড়িসুদ্ধ লোক হতবুদ্ধি । ভূমিকম্প যখন পৃথিবীর গভীর গর্ভ থেকে মাথা নাড়া দিয়ে ওঠে তখন লুকে চাপা দেবার চেষ্টা কের দিছে, নিরুপারভাবে তার ভাঙাচােরা সহ্য করতেই হয়—এও NO দিনরাত চলছে। নির্জল ব্রান্ডি। খাওয়াদাওয়া প্রায় নেই। একে শরীর পূর্ব থেকেই ছিল অবসন্ন, তার পরে এই প্ৰচণ্ড অনিয়মে বিকারের সঙ্গে রক্তবমন দেখা দিল । কলকাতা থেকে ডাক্তার এল- দিনরাত মাথায় বরফ চাপিয়ে রাখলে । মুকুন্দলাল যাকে দেখেন খেপে ওঠেন, তার বিশ্বাস তীর বিরুদ্ধে বাড়িসুদ্ধ লোকের চক্রান্ত । ভিতরে ভিতরে একটা নালিশ গুমরে উঠছিল- এরা যেতে দিলে কেন ? একমাত্র মানুষ যে তার কাছে আসতে পারত। সে কুমুদিনী । সে এসে পাশে বসে ; ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে মুকুন্দলাল চেয়ে দেখেন— যেন মা’র সঙ্গে ওর চােখে কিংবা কোথাও একটা মিল দেখতে পান। কখনো কখনো বুকের উপরে তার মুখ টেনে নিয়ে চুপ করে চোখ বুজে থাকেন, চোখের কোণ দিয়ে জল পড়তে থাকে, কিন্তু কখনো ভুলে একবার তার মা'র কথা জিজ্ঞাসা করেন না। এ দিকে বৃন্দাবনে টেলিগ্রাম গেছে। কত্রীঠাকরুনের কােলই ফেরবার কথা । কিন্তু শোনা গেল, কোথায় এক জায়গায় রেলের লাইন গেছে ভেঙে | a. সেদিন তৃতীয়া ; সন্ধ্যাবেলায় ঝড় উঠল। বাগানে মড় মড় করে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে। থেকে থেকে বৃষ্টির ঝাপটা বঁকানি দিয়ে উঠছে ক্রুদ্ধ অধৈর্যের মতো । লোকজন খাওয়াবার জন্যে যে চালাঘর তোলা হয়েছিল তার করোগেটেড লোহার চাল উড়ে দিঘিতে গিয়ে পড়ল । বাতাস বািণবিদ্ধ বাঘের মতো গো গো করে গোঙরাতে গোঙরাতে আকাশে আকাশে লেজ ঝাপটা দিয়ে পাক খেয়ে বেড়ায় । হঠাৎ বাতাসের এক দমকে জানলাদরজাগুলো খড় খড় করে কেঁপে উঠল । কুমুদিনীর হাত চেপে ধরে মুকুন্দলাল বললেন, “মা কুমু, ভয় নেই, তুই তো কোনো দোষ করিস নি। ঐ শোন দাতকড়মড়ানি, ওরা আমাকে মারতে আসছে।” বাবার মাথায় বরফের পুঁটুলি বুলোতে বুলোতে কুমুদিনী বলে, “মারবে কেন বাবা ? ঝড় হচ্ছে ; এখনই থেমে যাবে ।” “বৃন্দাবন ? বৃন্দাকান- চন্দ্র চক্রবতী ! বাবার আমলের পুরুত— সে তো মরে গেছে- ভূত হয়ে গেছে বৃন্দাবনে। কে বললে সে আসবে ?” “কথা কোয়ো না বাবা, একটু ঘুমোও ।”