পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

CD& রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী । yr বাবার মৃত্যুর পর বিপ্রদাস দেখলে, যে গাছে তাদের আশ্রয় তার শিকড় খেয়ে দিয়েছে পোকায় । বিষয়সম্পত্তি ঋণের চােরাবালির উপর দাড়িয়ে- অল্প করে ডুবছে। ক্রিয়াকর্ম সংক্ষেপ ও চালচলন খাটাে না করলে উপায় নেই। কুমুর বিয়ে নিয়েও কেবলই প্রশ্ন আসে, তার উত্তর দিতে মুখে বাধে। কালে নুরুনগর থেকে বাসা তুলতে হল। কলকাতায় বাগবাজারের দিকে একটা বাড়িতে এসে পুরোনাে বাড়িতে কুমুদিনীর একটা প্রাণময় পরিমণ্ডল ছিল। চারি দিকে ফুলফল, গোয়ালঘর, পুজোবাড়ি, শস্যখেত, মানুষজন। অন্তঃপুরের বাগানে ফুল তুলেছে, সাজি ভরেছে, নুন-লঙ্কা ধনেপাতার সঙ্গে। কঁচা কুল মিশিয়ে অপথ্য করেছে ; চালতা পেড়েছে, বোশেখ-জষ্টির ঝড়ে আমবাগানে আম কুড়িয়েছে। বাগানের পূর্বপ্রান্তে টেকিশাল, সেখানে লাড়ুকোটা প্রভৃতি উপলক্ষে মেয়েদের কলকোলাহলে তারও অল্প কিছু অংশ ছিল । শ্যাওলায়-সবুজ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা খিড়কির পুকুর ঘন ছায়ায় স্নিগ্ধ, কোকিল-ঘুঘু-দোয়েল-শ্যামার ডাকে মুখরিত। এইখানে প্রতিদিন সে জলে কেটেছে সঁতার, নালফুল তুলেছে, ঘাটে বসে দেখেছে খেয়াল, আনমনে একা বসে করেছে। পশম সেলাই । ঋতুতে ঋতুতে মাসে মাসে প্রকৃতির উৎসবের সঙ্গে মানুষের এক-একটি পরব বাধা । অক্ষয়তৃতীয়া থেকে দোলযাত্রা বাসন্তীপুজো পর্যন্ত কত কী। মানুষে প্রকৃতিতে হাত মিলিয়ে সমস্ত বছরটিকে যেন নানা কারুশিল্পে বুনে তুলছে। সবই যে সুন্দর, সবই যে সুখের তা নয়। মাছের ভাগ, পুজোর পার্বণী, কত্রীর পক্ষপাত, ছেলেদের কলহে স্ব-স্ব ছেলের পক্ষসমর্থন প্রভৃতি নিয়ে নীরবে ঈর্ষা বা তারস্বরে অভিযোগ, কানে কানে পরিচর্চা বা মুক্তকণ্ঠে অপবাদ ঘোষণা, এ-সমস্ত প্রচুর পরিমাণেই আছে- সব চেয়ে আছে নিত্যনৈমিত্তিক কাজের রাস্ততার ভিতরে ভিতরে নিয়ত একটা উদবেগ— কর্তা কখন কী করে বসেন, তার বৈঠকে কখন কী দুৰ্যোগ আরম্ভ হয়। যদি আরম্ভ হল। তবে দিনের পর দিন শান্তি নেই। কুমুদিনীর বুক দূর দূর করে, ঘরে লুকিয়ে মা কঁদেন, ছেলেদের মুখ শুকনো । এই সমস্ত শুভে অশুভে সুখে দুঃখে সর্বদা আন্দোলিত প্ৰকাণ্ড সংসারযাত্রা । , এরই মধ্যে থেকে কুমুদিনী এল কলকাতায়। এ যেন মস্ত একটা সমুদ্র কিন্তু কোথায় একফোটা পিপাসার জল ? দেশে আকাশের বাতাসেরও একটা চেনা চেহারা ছিল । গ্রামের দিগন্তে কোথাও-বা ঘন বন, কোথাও-বাঁ বালির চর, নদীর জলরেখা, মন্দিরের চুড়ো, শূন্য বিস্তৃত মাঠ, বুনো ঝাউয়ের ঝোপ, গুণটানা পথ- এরা নানা রেখায় নানা রঙে বিচিত্র ঘের দিয়ে আকাশকে একটি বিশেষ আকাশ করে তুলেছিল- কুমুদিনীর আপনি আকাশ। সূর্যের আলোও ছিল তেমনি বিশেষ আলো । দিঘিতে, শস্যখেতে, বেতের ঝাড়ে, জেলে-নীেকোর খয়েরি রঙের পালে, বঁাশঝাড়ের কচি ডালের চিকন পাতায়, কঁঠালগাছের মসৃণ ঘন সবুজে, ও পারের বালুতটের ফ্যাকাশে হলদে- সমস্তর সঙ্গে নানা ভাবে মিশিয়ে সেই আলো একটি চিরপরিচিত রূপ পেয়েছিল । কলকাতার এই-সব অপরিচিত বাড়ির ছাদে দেয়ালে কঠিন অনস্ৰ রেখার আঘাতে নানাখানা হয়ে সেই চিরদিনের আকাশ আলো তাকে বেগােনা লোকের মতো কড়া চোখে দেখে । এখানকার দেবতাও তাকে একঘরে করেছে। । বিপ্রদাস তাকে কেদারার কাছে টেনে নিয়ে বলে, “কী কুমু, মন কেমন করছে ?” কুমুদিনী হেসে বলে, “না দাদা, একটুও না।” “যাবি বােন, মুজিয়ম দেখতে ?” “হ্যা, যাব ।” এত বেশি উৎসাহের সঙ্গে বলে যে, বিপ্রদাস যদি পুরুষমানুষ না হত। তবে বুঝতে পারত যে এটা স্বাভাবিক নয়। মুজিয়মে না যেতে হলেই সে বঁাচে । বাইরের লোকের ভিড়ের মধ্যে বেরোনো অভ্যোস নেই বলে জনসমাগমে যেতে তার সংকোচের অন্ত নেই। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, চোখ চেয়ে ভালো করে দেখতেই পারে না ।