পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ NOVA দৈহিক পীড়ার কথা আছে। তারও প্রমাণ হাতে হাতে, কাল রাত থেকে স্পষ্টই সন্দির লক্ষণ । আষাঢ় মাসও পড়ল- পত্নীর পীড়া ও মৃত্যুর কথাটা ভাববার আশু প্রয়োজন নেই, অতএব এবার সময় ভালো । কুমু দাদার পাশে বসে বললে, “দাদা, মাথা ধরেছে কি ?” দাদা বললে, “না ।” “চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যায় নি ? তোমার ঘরে লোক দেখে ঢুকতে পারলুম না ।” বিপ্রদাস কুমুর মুখের দিকে চেয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। ভাগ্যের নিষ্ঠুরতা সব চেয়ে অসহ্য, যখন সে সোনার রথ আনে যার চাকা অচল। দাদার মুখভাবে এই দ্বিধার বেদনা কুমুকে ব্যথা দিলে । দৈবের দানকে কেন দাদা এমন করে সন্দেহ করছেন ? বিবাহ-ব্যাপারে নিজের পছন্দ বলে যে একটা উপসৰ্গ আছে। এ চিন্তা কখনো কুমুদিনীর মাথায় আসে নি । শিশুকাল থেকে পরে পরে সে তার চার দিদির বিয়ে দেখেছে। কুলীনের ঘরে বিয়ে- কুল ছাড়া আর বিশেষ কিছু পছন্দর বিষয় ছিল তাও নয় । ছেলে।পুলে নিয়ে তবু তারা সংসার করছে, দিন কেটে যাচ্ছে । যখন দুঃখ পায় বিদ্রোহ করে না ; মনে ভাবতেও পারে না যে কিছুতেই এটা ছাড়া আর কিছুই হতে পারত। মা কি ছেলে বেছে নেয় ? ছেলেকে মেনে নেয়। কুপুত্রও হয় সুপুত্রও হয় । স্বামীও তেমনি । বিধাতা তো দোকান খোলেন নি । ভাগ্যের উপর বিচার চলবে কার ? এতদিন পরে কুমুর মন্দভাগ্যের তেপান্তর মাঠ পেরিয়ে এল রাজপুত্র ছদ্মবেশে । রথচক্রের শব্দ কুমু তার হৃৎস্পন্দনের মধ্যে ঐ-যে শুনতে পাচ্ছে। বাইরের ছদ্মবেশটাি সে যাচাই করে দেখতেই চায় না | তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়েই সে পাজি খুলে দেখলে, আজ মনোরথ-দ্বিতীয়া । বাড়িতে কর্মচারীদের মধ্যে যে-কয়জন ব্ৰাহ্মণ আছে সন্ধ্যাবেলা ডাকিয়ে তাদের ফলার করালে, দক্ষিণাও যথাসাধ্য কিছু দিলে । সবাই আশীর্বাদ করলে, রাজরানী হয়ে থাকো, ধনে-পুত্রে লক্ষ্মীলাভ হােক । দ্বিতীয়বার বিপ্রদাসের বৈঠকখানায় ঘটকের আগমন । তুড়ি দিয়ে “শিব শিব’ বলে বৃদ্ধ উচ্চস্বরে হাই তুললে । এবারে অসম্মতি দিয়ে কথাটাকে শেষ করে দিতে বিপ্রদাসের সাহস হল না । ভাবলে এতবড়ো দায়িত্ব নিই। কী করে ? কেমন করে নিশ্চয় জানব কুমুর পক্ষে এ সম্বন্ধ সব চেয়ে ভালো নয় ? পরশুদিন শেষ কথা, দেবে বলে। ঘটককে বিদায় করে দিলে । Σ Σ সন্ধ্যার অন্ধকার মেঘের ছায়ায় বৃষ্টির জলে নিবিড় । কুমুর আসবাবপত্র বেশি কিছু নেই। এক পাশে ছোটাে খাট, আলনায় গুটি-দুয়েক পাকানো শাড়ি আর চপা-রঙের গামছা । কোণে কঁঠাল-কাঠের সিন্দুক, তার মধ্যে ওর ব্যবহারের কাপড় । খাটের নীচে সবুজ-রঙ-করা টিনের বাক্সে পান সাজবার সরঞ্জাম, আর-একটা বাক্সে চুল বঁাধবার সামগ্ৰী । দেয়ালের খাজের মধ্যে কাঠের থাকে কিছু বই, দোয়াতকলম, চিঠির কাগজ, মায়ের হাতের পশমে-বোনা বাবার সর্বদা ব্যবহারের চটিজুতোজোড়া ; শোবার খাটের শিয়রে রাধাকৃষ্ণের যুগলরাপের পাট । দেয়ালের কোণে ঠেসানো একটা এসরাজ । r ঘরে কুমু আলো জ্বালায় নি । কাঠের সিন্দুকের উপর বসে জানলার বাইরে চেয়ে আছে। সামনে ইটের কলেবরওয়ালা কলকাতা আদিম কালের বর্মকঠিন একটা অতিকায় জন্তুর মতো, জলধারার মধ্যে দিয়ে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার গায়ে গায়ে আলোকশিখার বিন্দু। কুমুর মন তখন ছিল অদৃষ্টনিরূপিত তার ভাবীলোকের মধ্যে । সেখানকার ঘরবাড়ি-লোকজন সবই তার আপনি আদর্শে গড়া । তারই মাঝখানে নিজের সতীলক্ষ্মী-রূপের প্রতিষ্ঠা- কত ভক্তি, কত পূজা, কত সেবা । তার নিজের মায়ের পুণ্যচরিতে এক জায়গায় একটা গভীর ক্ষত রয়ে গেছে। তিনি স্বামীর অপরা.ে কিছুকালের জন্যেও ধৈর্য হারিয়েছিলেন । কুমু কখনো সে ভুল করবে না।