পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(98O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী পূর্বেই বলেছি কুমুদিনীর মন একালের ছাচে নয়। জাতকুলের পবিত্রতা তার কাছে খুব একটা । বাস্তব জিনিস। মনটা তাই যতই সংকুচিত হয়ে ওঠে ততই যারা নিন্দে করে তাদের উপর রাগ করে ; ঘর থেকে হঠাৎ কেঁদে উঠে। ছুটে বাইরে চলে যায়। সবাই গা-টেপাটেপি করে বলে, “ইস, এখনই এত দরদ ! এ যে দেখি দক্ষযজ্ঞের সতীকেও ছাড়িয়ে গেল।” বিপ্ৰদাসের মনের গতি হাল-আমলের, তবু জাতকুলের হীনতায় তাকে কাবু করে । তাই, গুজবটা চাপা দেবার অনেক চেষ্টা করলে। কিন্তু ছেড়া বালিশে চাপ দিলে তার তুলো যেমন আরো বেশি বেরিয়ে পড়ে, তেমনি হল । এ দিকে বুড়ো প্ৰজা দামোদর বিশ্বাসের কাছে খবর পাওয়া গেল যে, বহুপূর্বে ঘোষালের নুরনগরের পাশের গ্রাম শেয়াকুলির মালেক ছিল । এখন সেটা চাটুজ্যেদের দখলে । ঠাকুর-বিসর্জনের মামলায় কী করে সবসুদ্ধ ঘোষালদেরও বিসর্জন ঘটেছিল, কী কৌশলে কর্তবাবুরা, শুধু দেশছাড়া নয়, তাদের সমাজছাড়া করেছিলেন, তার বিবরণ বলতে বলতে দামোদরের মুখ ভক্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে । ঘোষালেরা এককালে ধনে মানে কুলে চাটুজ্যেদের সমকক্ষ ছিলেন এটা সুখবর, কিন্তু বিপ্ৰদাসের মনে ভয় লাগল যে, এই বিয়েটাও সেই পুরাতন মামলার একটা জের নাকি ? SV) অম্লান মাসে বিয়ে। পঁচিশে আশ্বিন লক্ষ্মীপুজো হয়ে গেল। হঠাৎ সাতাশে আশ্বিনে তাবু ও নানাপ্রকার সাজসরঞ্জাম নিয়ে ঘোষাল-কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ওভারসিয়র এসে উপস্থিত, সঙ্গে একদল পশ্চিমি মজুর। ব্যাপারখানা কী ? শেয়াকুলিতে ঘোষালদিঘির ধারে তীবু গেড়ে বর ও বরযাত্রীরা কিছুদিন আগে থাকতেই সেখানে এসে উঠবেন। এ কী রকম কথা ? বিপ্রদাস বললে, “তারা যতজন খুশি আসুন, যতদিন খুশি থাকুন, আমরাই বন্দোবস্ত করে দেব । তাবুর দরকার কী ? আমাদের স্বতন্ত্র বাড়ি আছে, সেটা খালি করে দিচ্ছি।” ওভারসিয়ার বললে, “রাজাবাহাদুরের হুকুম । দিঘির চারি ধারের বনজঙ্গলও সাফ করে দিতে বলেছেন— আপনি জমিদার, অনুমতি চাই ।” --রািগ্লাস মুখ লাল করে বললে, “এটা কি উচিত হচ্ছে? জঙ্গল তাে আমরাই সাফ করে দিতে टू ।" ওভারসিয়র বিনীতভাবে উত্তর করলে, “ঐখানেই রাজাবাহাদুরের পূর্বপুরুষের ভিাটবাড়ি, তাই শখ হয়েছে নিজেই ওটা পরিষ্কার করে নেবেন ।” কথাটা নিতান্ত অসংগত নয়, কিন্তু আত্মীয়স্বজনেরা খুঁত খুঁত করতে লাগল। প্রজারা বলে, এটা আমাদের কর্তবাবুদের উপর টেক্কা দেবার চেষ্টা । হঠাৎ তবিল ফেপে উঠেছে, সেটা ঢাকা দিতে পারছে না ; সেটাকে জয়ঢাকা করে তোলবার জন্যেই না। এই কাণ্ড ; সাবেক আমল হলে বরস্সুদ্ধ বরসজা বৈতরণী পার করতে দেরি হত না । ছোটােবাবু থাকলে তিনিও সইতেন না, দেখা যেত। ঐ বাবুগুলো আর র্তাবুগুলো থাকত কোথায় । প্রজারা এসে বিপ্রদাসকে বললে, “হুজুর, ওদের কাছে হঠতে পারব না। যা খরচ লাগে আমরাই (नद ।” ছয়-আনার কর্তা নবগোপাল এসে বললে, “বংশের অমর্যাদা সওয়া যায় না । একদিন আমাদের কর্তারা ঐ ঘোষালদের হাড়ে হাড়ে ঠকাঠকি লাগিয়েছেন, আজ তারা আমাদেরই এলাকার উপর চড়াও হয়ে টাকার বালক মারতে এসেছে । ভয় নেই দাদা, খরচ যা লাগে আমরাও আছি । বিষয় ভাগ হােক, বংশের মান তো ভাগ হয়ে যায় নি ।” এই বলে নবগোপালই ঠেলেঠলে কর্মকর্তা হয়ে বসল। বিপ্রদাস কয়দিন কুমুর কাছে যেতে পারে নি। তার মুখের দিকে তাকাবে কী করে ? কুমুর কাছে বরপক্ষের স্পর্ধার কথা কেউ যে গলা খাটো করে বলবে সমাজে সে দয়া বা ভদ্রতা নেই। তারই কাছে