পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ONO কুমুদিনী বললে, “ওটা আমিই রেখে দেব।” মধুসূদন বিরক্ত হয়ে হেঁকে উঠল, “রেখে লাভ কী ? মনে ভাবিছ, এটা ভারি একটা দামি জিনিস ! এ কিছুতেই তোমার পরা চলবে না, বলে দিচ্ছি।” কুমুদিনী বললে, “আমি পরব না।” বলে সেই পুঁতির কাজ-করা থলেটির মধ্যে আংটি রেখে দিলে । , r “কেন, এই সামান্য জিনিসটার উপরে এত দরদ কেন ? তোমার তো জেদ কম নয় ?” মধুসূদনের আওয়াজটা খরখরে ; কানে বাজে, যেন বেলে-কাগজের ঘর্ষণ। কুমুদিনীর সমস্ত শরীরটা রী রী করে উঠল । ❖። “এ আংটি তোমাকে দিলে কে ?” “তোমার মা নাকি ?” নিতান্তই জবাব দিতে হবে বলেই অর্ধস্ফুটম্বরে বললে, “দাদা ।” দাদা ! সে তো বোঝাই যাচ্ছে। দাদার দশা যে কী, মধুসূদন তা ভালোই জানে। সেই দাদার আংটি শনির সিধকাঠি- এ ঘরে আনা চলবে না । কিন্তু তার চেয়েও ওকে এইটেই খোচা দিচ্ছে যে, এখনো কুমুদিনীর কাছে ওরা দাদাই সব চেয়ে বেশি। সেটা স্বাভাবিক বলেই যে সেটা সহ্য হয় তা নয় । , পুরোনো জমিদারের জমিদারি নতুন ধনী মহাজন নিলেমে কেনার পর ভক্ত প্ৰজারা যখন সাবেক আমলের কথা স্মরণ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতে থাকে তখন আধুনিক অধিকারীর গায়ের জ্বালা ধরে, এও তেমনি । আজ থেকে আমিই যে ওর একমাত্র, এই কথাটা যত শীঘ্ৰ হােক। ওকে জানান দেওয়া চাই । তা ছাড়া গায়ে-হলুদের খাওয়ানো নিয়ে বরের যা অপমান হয়েছে তাতে বিপ্রদাস নেই। এ কথা মধুসূদন বিশ্বাস করতেই পারে না। যদিও নবগোপাল বিবাহের পরদিনে ওকে বলেছিল, “ভায়া, বিয়েবাড়িতে তোমাদের হাটখোলার আড়ত থেকে যে-চালচলনের আমদানি করেছিলে, সে কথাটা ইঙ্গিতেও দাদাকে জানিয়ো না ; উনি এর কিছুই জানেন না, ওঁর শরীরও বড়ো খারাপ ।” আংটির কথাটা আপাতত স্থগিত রাখলে, কিন্তু মনে রইল । এ দিকে রূপ ছাড়া আরো একটা কারণে হঠাৎ কুমুদিনীর দর বেড়ে গিয়েছে। নুরনগরে থাকতেই ঠিক বিবাহের দিনে মধুসূদন টেলিগ্রাফ পেয়েছে যে, এবার তিসি চালানের কাজে লাভ হয়েছে প্ৰায় বিশ লাখ টাকা। সন্দেহ রইল না, এটা নতুন বধূর পয়ে। স্ত্রীভাগ্যে ধন, তার প্রমাণ হাতে হাতে । তাই কুমুকে পাশে নিয়ে গাড়িতে বসে ভিতরে ভিতরে এই পরম পরিতৃপ্তি তার ছিল যে, ভাবী মুনফার একটা জীবন্ত বিধিদত্ত দলিল নিয়ে বাড়ি চলেছে। এ নইলে আজকের এই বুহাম-রথযাত্রার পালটায় অপঘাত ঘটতে পারত । r রাজা উপাধি পাওয়ার পর থেকে কলকাতায় ঘোষালবাড়ির দ্বারে নাম খােদা হয়েছে ‘মধুপ্রাসাদ । সেই প্রাসাদের লোহার গেটের এক পাশে আজ নহবত বসেছে, আর বাগানে একটা তাঁবুতে বাজছে ব্যাণ্ড । গেটের মাথায় অর্ধচন্দ্ৰাকারে গ্যাসের টাইপে লেখা “প্রজাপতিয়ে নমঃ” । সন্ধ্যাবেলায় আলোকশিখায় এই লিখনটি সমুজ্জ্বল হবে। গেট থেকে কঁাকর-দেওয়া যে পথ বাড়ি পর্যন্ত গেছে তার দুই ধারে দেবদারুপাতা ও গীদার মালায় শোভাসজ্জা ; বাড়ির প্রথম তলার উচু মেজেতে ওঠবার সিঁড়ির ধাপে লালসালু পাতা। আত্মীয়বন্ধুর জনতার ভিতর দিয়ে বরকনের গাড়ি গাড়িবারান্দায় এসে থােমল। শাখ উলুধ্বনি ঢাক ঢোল কঁাসির নহবত ব্যাণ্ড সব একসঙ্গে উঠল বেজে- যেন দশ-পনেরোটা আওয়াজের মালগাড়ির এক জায়গাতে পুরো বেগে ঠোকাঠুকি ঘটল। মধুসূদনের কোন এক সম্পর্কের দিদিমা, পরিপাক বুড়ি, সিঁথিতে যত মোটা ফ্লাক তত মোটা সিঁদুর, চওড়া-লাল-পেড়ে শাড়ি, মোটা হাতে মোটা মোটা সোনার বালা এবং শাখার চুড়ি, একটা রুপের