পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

w©(፩br রবীন্দ্র-রচনাবলী একটা বালাই ছিল না। ছোটােছেলে কঁচা ফলটাকে যেমন টপ করে বিনা আয়োজনে মুখে পুরে দেয়, স্বামীর সংসার তেমনি করেই বিনা বিচারে আমাদের গিলেছে, কোথাও কিছু বাধে নি। সাধন করে আমাদের নিতে হয় নি, আমাদের জন্যে দিন-গোনা ছিল অনাবশ্যক। যেদিন বললে ফুলশয্যে সেইদিনই হল ফুলশয্যে, কেননা ফুলশয্যের কোনো মানে ছিল না, সে ছিল একটা খেলা । এই তো কালই হবে ফুলশয্যে, কিন্তু এ মেয়ের পক্ষে সে কতবড়ো বিড়ম্বনা ! বড়েঠাকুর এখনো পর ; আপন হতে অনেক সময় লাগে । একে ছোবে কী করে ? এ মেয়ের সেই অপমান সইবে কেন ? ধন পেতে বড়ো ঠাকুরের কত কাল লাগল আর মন পেতে দুদিন সবুর সইবে না ? সেই লক্ষ্মীর দ্বারে হাঁটাইটি করে মরতে হয়েছে, এ লক্ষ্মীর দ্বারে একবার হাত পাততে হবে না ? এত কথা মোতির মা'র মনে আসত না । এসেছে তার কারণ, কুমুকে দেখবা মাত্রই ও তাকে সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে। এই ভালোবাসার পূর্বভূমিকা হয়েছিল স্টেশনে যখন সে দেখেছিল বিপ্রদাসকে । যেন মহাভারত থেকে ভীষ্ম নেমে এলেন । বীরের মতো তেজস্বী মূর্তি, তাপসের মতো শান্ত মুখশ্ৰী, তার সঙ্গে একটি বিষাদের নম্রতা ! মােতির মা'র মনে হয়েছিল। কেউ যদি কিছু না বলে তবে একবার ওর পা দুটাে ছুয়ে আসি । সেই রূপ আজও সে ভুলতে পারে নি। তার পরে যখন কুমুকে দেখলে, মনে মনে বললে, দাদারই বোন বটে । ” একরকম জাতিভেদ আছে যা সমাজের নয়, যা রক্তের- সে জাত কিছুতে ভাঙা যায় না । এই যে রক্তগত জাতের অসামঞ্জস্য এতে মেয়েকে যেমন মর্মান্তিক করে মারে পুরুষকে এমন নয় । অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল বলে মোতির মা এই রহস্য নিজের মধ্যে বোঝবার সময় পায় নি- কিন্তু কুমুর ভিতর দিয়ে এই কথাটা সে নিশ্চিত করে অনুভব করলে । তার গা কেমন করতে লাগল। ও যেন একটা বিভীষিকার ছবি দেখতে পেলে- যেখানে একটা অজানা জন্তু লালায়িত রসনা মেলে গুড়ি মেরে বসে আছে, সেই অন্ধকার গুহার মুখে কুমুদিনী দাড়িয়ে দেবতাকে ডাকছে। মোতির মা রেগে উঠে মনে মনে বললে, “দেবতার মুখে ছাই ! যে-দেবতা ওর বিপদ ঘটিয়েছে সেই নাকি ওকে উদ্ধার করবে ! হায় রে !” SR8 পরের দিন সকালেই কুমু দাদার কাছ থেকে টেলিগ্রাম পেয়েছে, “ভগবান তোমাকে আশীৰ্বাদ করুন।” সেই টেলিগ্রামের কাগজখানি জামার মধ্যে বুকের কাছে রেখে দিলে। এই টেলিগ্রামে যেন দাদার দক্ষিণ হাতের স্পর্শ । কিন্তু দাদা নিজের শরীরের কথা কেন কিছুই লিখলে না ? তবে কি অসুখ বেড়েছে ? দাদার সব খবরই মুহুর্তে মুহুর্তে যার প্রত্যক্ষগোচর ছিল, আজ তার কাছে সবই অবরুদ্ধ। আজ ফুলশয্যে, বাড়িতে লোকারণ্য । আত্মীয়-মেয়েরা সমস্তদিন কুমুকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। কিছুতে তাকে একলা থাকতে দিলে না। আজ একলা থাকবার বড়ো দরকার ছিল । শোবার ঘরের পাশেই ওর নাবার ঘর ; সেখানে জলের কল পাতা এবং ধারামানের বঁাঝারি বসানো । কোনো অবকাশে বাক্স থেকে যুগল-রূপের ফ্ৰেমে-বাধানো পাটখনি বের করে স্নানের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল । সাদা পাথরের জলচৌকির উপর পাট রেখে সামনে মাটিতে বসে নিজের মনে বার বার করে বললে, “আমি তোমারই, আজ তুমিই আমাকে নাও । সে আর কেউ নয়, সে তুমিই, সে তুমিই, সে তুমিই। তোমারই যুগল-রূপ প্ৰকাশ হােক আমার জীবনে ৷” ডাক্তাররা বলছে বিপ্রদাসের ইনফ্লুয়েঞ্জা ন্যুমোনিয়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। নবগোপাল একলা কলকাতায় এল ফুলশয্যার সওগাত পাঠাবার ব্যবস্থা করতে । খুব ঘটা করেই সওগাত পাঠানো হল । বিপ্রদাস নিজে থাকলে এত আড়ম্বর করত না। কুমুর বিবাহ উপলক্ষে ওর বড়ো বোন চারজনকেই আনতে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু খবর রটে গেছে— ঘোষালরা সদব্ৰাহ্মণ নয়। বাড়ির লোক এ-বিয়েতে কিছুতে তাদের পাঠাতে রাজি হল না। কুমুর তৃতীয় বোন যদি বা স্বামীর সঙ্গে ঝগড়াঝাটি করে বিয়ের পরদিন কলকাতায় এসে পৌঁছেলি,