পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV8 রবীন্দ্র-রচনাবলী কোনো সাড়াশব্দ নেই। সাবধানে দরজা খুলে দেখে, কুমু মেজের উপর একটা মাদুর পেতে শুয়ে, সেই মাদুরের এক প্রান্ত গুটিয়ে সেইটেকে বালিশ করেছে। মধুসূদনের যেমন ঘুম নেই, কুমুরও তেমনি ঘুম না থাকাই উচিত ছিল, কিন্তু দেখলে সে অকাতরে ঘুমোচ্ছে ; এমন-কি, তার মুখের উপর যখন লষ্ঠনের আলো ফেললে তাতেও ঘুম ভাঙল না। এমন সময় কুমু একটুখানি উসফুস করে পাশ ফিরলে । গৃহস্থের জাগার লক্ষণ দেখে চোর। যেমন করে পালায় মধুসূদন তেমনি তাড়াতাড়ি পালাল। ভয় হল পাছে কুমু ওর পরাভব দেখতে পায়, পাছে মনে মনে হাসে । বাতির ঘর থেকে মধুসূদন বেরিয়ে এসে বারান্দা বেয়ে খানিকটা যেতেই সামনে দেখে শ্যামা । তার হাতে একটি প্ৰদীপ । “একি ঠাকুরপো, এখানে কোথা থেকে এলে ?” মধুসূদন তার কোনো উত্তর না করে বললে, “তুমি কোথায় যােচ্ছ বউ ?” “কাল যে আমার ব্ৰত, ব্ৰাহ্মণভোজন করাতে হবে তারই জোগাড়ে চলেছি- তোমারও নেমস্তন্ন রইল । কিন্তু তোমাকে দক্ষিণে দেবার মতো শক্তি নেই ভাই ।” মধুসূদনের মুখে একটা জবাব আসছিল, সেটা চেপে গেল। সেই শেষরাত্রের অন্ধকারে প্রদীপের আলোয় শ্যামাকে সুন্দর দেখাচ্ছিল। শ্যামা একটু হেসে বললে, “আজ ঘুম থেকে উঠেই তোমার মতো ভাগ্যবান পুরুষের মুখ দেখলুম, আমার দিন ভালোই যাবে । ব্ৰত সফল হবে ।” ভাগ্যবান শব্দটার উপর একটু জোর দিলে- মধুসূদনের কানে কথাটা বিড়ম্বনার মতো শোনাল। কুমুর সম্বন্ধে কোনো কথা স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করতে শ্যামার সাহস হল না। “কাল কিন্তু আমার ঘরে খেতে এসো, মাথা খাও” বলে সে চলে গেল । ঘরে এসে মধুসূদন বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাইরে লন্ঠনটা রাখলে, যদি কুমু আসে। কুমুদিনীর সেই সুপ্ত মুখ কিছুতে মন থেকে নড়তে চায় না ; আর কেবলই মনে পড়ে কুমুর অতুলনীয় সেই হাতখানি শালের বাইরে এলিয়ে। বিবাহকালে এই হাত যখন নিজের হাতে নিয়েছিল তখন একে সম্পূর্ণ দেখতে পায় নি- আজ দেখে দেখে চােখের আর আশ মিটতে চায় না । এই হাতের অধিকারটি সে কবে। পাবে ? বিছানায় আর টিকতে পারে না ; উঠে পড়ল। আলো জ্বালিয়ে কুমুর ডেস্কের দেরাজ খুললে । দেখলে সেই পুঁতি-গাথা থলিটি । প্রথমেই বেরোল বিপ্রদাসের টেলিগ্রামখানি- “ঈশ্বর তোমাকে আশীৰ্বাদ করুন”- তার পরে একখানি ফোটােগ্রাফ, ওর দুই দাদার ছবি- আর একখানি কাগজের টুকরো, বিপ্রদাসের হাতে-লেখা গীতার এই শ্লোক যৎ করোষি যদগ্নাসি যজুহােষি দদাসি যৎ, যৎ তপস্যসি, কৌন্তেয়, তৎকুরুষ মদৰ্পণম | * ঈর্ষায় মধুসূদনের মন ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। দাতে দাতে লাগিয়ে বিপ্রদাসকে মনে মনে লোপ করে দিলে। সেই লুপ্তির দিন একদা আসবে ও নিশ্চয় জানে— অল্প অল্প করে ক্রু আঁটতে হবে ; কিন্তু কুমুদিনীর যে-উনিশটা বছর মধুসূদনের আয়ত্তের বাইরে, সেইটে বিপ্রদাসের হাত থেকে এই মুহুর্তেই ছিনিয়ে নিতে পারলে তবেই ও মনে শান্তি পায়। আর কোনো রাস্তা জানে না জবরদস্তি ছাড়া । পুঁতির থলিটি আজ সাহস করে ফেলে দিতে পারলে না- যেদিন আংটি হরণ করে নিয়েছিল সেদিন ওর সাহস আরো বেশি ছিল ; তখনাে জানত কুমুদিনী সাধারণ মেয়েরই মতো সহজেই শাসনের অধীন, এমন-কি, শাসনই পছন্দ করে । আজ বুঝেছে কুমুদিনী যে কী করতে পারে এবং পারে না কিছু বলবার (छों (नई । কুমুদিনীকে নিজের জীবনের সঙ্গে শক্ত বাধনে জড়বার একটি মাত্র রাস্তা আছে, সে কেবল সন্তানের মায়ের রাস্তা । সেই কল্পনাতেই ওর সাত্মনা । এমনি করে ঘড়িতে পাচটা বাজল । কিন্তু শীতরাত্রির অন্ধকার তখনো যায় নি। আর কিছুক্ষণ পরেই আলো উঠবে, আজকের রাত হবে ব্যৰ্থ। মধুসূদন তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে চলল- ফরাশখানার