পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

७१२ রবীন্দ্র-রচনাবলী থেমেছে। অপমানের বিরক্তি কমে এসে বিষাদের মানতায় এখন তার মন ছায়াচ্ছন্ন । বুঝতে পারছে চিরদিনের ব্যবস্থা এ নয়। অথচ সেরকম একটা ব্যবস্থা না হলে কুমু বঁাচবে কী করে ? সংসারে 'আমৃত্যুকাল দিনরাত্রি জোর করে এরকম অসংলগ্নভাবে থাকা তো সম্ভবপর নয়। এই কথাই সে ভাবছিল তার ঘরের দরজা বন্ধ করে । ঘরটা বারান্দার এক কোণে, কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। প্রবেশের দ্বার ছাড়া বাকি সমস্ত কুঠরি অবরুদ্ধ। দেয়ালের গায়ে উপর পর্যন্ত কাঠের থাক বসানো । সেই থাকে আলো জ্বালাবার বিচিত্র সরঞ্জাম । তৈলাক্ত মলিনতায় ঘরটা আগাগোড়া ক্লিান্ন। দেয়ালের যে অংশে দরজা সেই দিকে বাতির মোড়ক থেকে কাটা ছবিগুলো ঐটে দিয়ে কোনো-এক ভূত্য সৌন্দর্যবোধের তৃপ্তিসাধন করেছিল। এক কোণে টিনের বাক্সে আছে ওঁড়োকরা খড়ি, তার পাশে ঝুড়িতে শুকনো তেঁতুল, এবং কতকগুলো ময়লা ঝাড়ন ; আর সারি সারি কেরোসিনের টিন, অধিকাংশই খালি, গুটি দুই-তিন ভরা । অনিপুণ হস্তে আজ সকাল থেকে কুমু তার কাজে লেগেছিল। ভঁড়ারের কর্তব্য শেষ করে মোতির মা উকি মেরে একবার কুমুর কর্মতপস্যার দুঃসাধ্য সংকটটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে । বুঝতে পারলে দুই-একটা ক্ষণভঙ্গুর জিনিসের অপঘােত আসন্ন। এ বাড়িতে জিনিসপত্রের সামান্য ক্ষুন্নতাও দৃষ্টি অথবা হিসাব এড়ায় না । মেতির মা আর থাকতে পারলে না ; বললে, “কােজ নেই হাতে, তাই এলুম। ভাবলুম দিদির কাজটাতে একটু হাত লগাই, পুণ্য হবে।” এই বলেই কাচের গ্লোব ও চিমনির ঝুড়ি নিজের কোলের কাছে টেনে নিয়ে মাজ-মোছায় লেগে গেল । আপত্তি করতে কুমুর আর তেজ নেই, কেননা ইতিমধ্যে আপন অক্ষমতা সম্বন্ধে আত্ম-আবিষ্কার প্রায় সম্পূর্ণ হয়েছে। মোতির মা'র সহায়তা পেয়ে বেঁচে গেল। কিন্তু মোতির মা'রও অশিক্ষিতাপটুত্বের সীমা আছে। কেরোসিন ল্যাম্পে হিসাব করে ফিতে যোজনা তার পক্ষে অসাধ্য । কাজটা হয় তারই তত্ত্বাবধানে, বরাদ্দ অনুসারে তেল প্রভৃতির মাপ তারই স্বহস্তে, কিন্তু হাতে-কলমে সলতে কাটা আজ পর্যন্ত তার দ্বারা হয় নি। তাই অগত্যা বুড়ো বন্ধু ফরাশকে সহযোগিতার জন্যে ডাকবার প্রস্তাব তুললে । 鱼 হার মানতে হল। বন্ধু ফরাশ এল, এবং দ্রুতহন্তে অল্পকালের মধ্যেই কাজ সমাধা করে দিলে। সন্ধ্যার পূর্বেই দীপগুলো ঘরে ঘরে ভাগ করে দিয়ে আসতে হয়। সেই কাজের জন্যে পূর্বনিয়মমত তাকে যথাসময়ে আসতে হবে কি না বন্ধু জিজ্ঞাসা করলে। লোকটা সরল প্রকৃতির বটে। কিন্তু তবু প্রশ্নের মধ্যে একটু শ্লেষ ছিল-‘বা । কুমুর কানের ডগা লাল হয়ে উঠল। সে কোনো জবাব করবার আগেই মোতির মা বললে, “আসবি না তো কী ?” কুমুর বুঝতে একটুও বাকি রইল না যে, কাজ করতে গিয়ে কেবল সে কাজের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। \ΟΣ দুপুরবেলা আহারের পর দরজা বন্ধ করে কুমু বসে পণ করতে লাগল, মনের মধ্যে কিছুতে সে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠতে দেবে না। কুমু বললে, “আজকের দিনটা লাগবে মনকে স্থির করে নিতে ; ঠাকুরের আশীৰ্বাদ নিয়ে কাল সকাল থেকে সংসারধর্মের সত্যপথে প্রবৃত্ত হব।” মধ্যাহ্নে আহারের পর তার কাঠের ঘরে দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়ে চলল নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া । এই কাজে সব চেয়ে সহায় ছিল তার দাদার স্মৃতি। সে যে দেখেছে তার দাদার ধৈর্যের আশ্চর্য গভীরতা ; তঁর মুখে সেই বিষাদ, যেটি তার অন্তরের মহত্ত্বের ছায়া- তার সেই দাদা, তখনকার কালে শিক্ষিতসমাজে প্রচলিত পজিটিভিজম ধার ধর্ম ছিল, দেবতাকে বাইরে থেকে প্ৰণাম করা যার অভ্যাস ছিল না, অথচ দেবতা। আপনিই যার জীবন পূর্ণ করে আবির্ভূত। অপরান্ত্রে বন্ধু ফরাশ যখন দরজায় আঘাত করলে, ঘর খুলে কুমু বেরিয়ে গেল। মোতির মাকে