পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VO38 রবীন্দ্র-রচনাবলী আর তারিখের কার্ড ঠিক করে দিই।” “আচ্ছা, ঘরে এসে শোনো ।” নবীন ত্ৰস্ত হয়ে কাঠগড়ার আসামির মতো চুপ করে দাড়িয়ে রইল। মধুসূদন বললে, “বড়োবউয়ের কানে মন্ত্র ফোসলাবার কেউ থাকে এটা আমি পছন্দ করি নে। আমার ঘরের বউ আমার ইচ্ছেমত চলবে, আর-কারও পরামর্শমত চলবে না- এইটে হল নিয়ম।” নবীন গভীরভাবে বললে, “সে তো ঠিক কথা ।” “তই আমি বলছি, মেজেবিউকে দেশে পাঠিয়ে দিতে হবে ।” নবীন খুব যেন নিশ্চিন্ত হল এমনি ভাবে বললে, “ভালো হল দাদা, আমি আরো ভাবছিলুম পাছে তোমার মত না হয় ।” মধুসূদন বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “তার মানে ?” নবীন বললে, “কদিন ধরে দেশে যাবার জন্যে মেজোবউ অস্থির করে তুলেছে, জিনিসপত্র সব গোছানোই আছে, একটা ভালো দিন দেখলেই বেরিয়ে পড়বে ।” বলা বাহুল্য, কথাটা সম্পূর্ণ বানানো। তার বাড়িতে মধুসূদন যাকে ইচ্ছে বিদায় করে দেবে, তাই বলে কেউ নিজের ইচ্ছায় বিদায় হতে চাইবে এটা সম্পূর্ণ বেদস্তুর। বিরক্তির স্বরে বললে, “কেন, যাবার জন্যে তার এত তাড়া কিসের ?” নবীন বললে, “বাড়ির গিন্নি এ বাড়িতে এসেছেন, এখন এ বাড়ির সমস্ত ভার তো তাকেই নিতে হবে । মেজেবিউ বললে, আমি মাঝে থাকলে কী জানি কখন কী কথা ওঠে ।” মধুসূদন বললে, “এসব কথার বিচারভার কি তারই উপরে ?” নবীন ভালোমানুষের মতো বললে, “কী করব বলো, মেয়েমানুষের জেদ। কী জানি, তার মনে হয়েছে, কোন কথা নিয়ে তুমি হয়তো একদিন হঠাৎ তাকে সরিয়ে দেবে, সে অপমান তার সইবে না- তাই সে একেবারে পণ করে বসেছে সে যাবেই। আসছে ত্রয়োদশী তিথিতে দিন পড়েছে- এর মধ্যে কাজকর্ম সব গুছিয়ে দিয়ে হিসাবপত্র চুকিয়ে সে চলে যেতে চায়।” মধুসূদন বললে, “দেখো নবীন, মেজেবিউকে আদর দিয়ে তুমিই বিগড়ে দিয়েছ। তাকে একটু কড়া করেই বোলো, সে কিছুতেই যেতে পারবে না। তুমি পুরুষমানুষ, ঘরে তোমার নিজের শাসন চলবে না, এ আমি দেখতে পারি। নে ৷” নবীন মাথা চুলকিয়ে বললে, “চেষ্টা করে দেখব। দাদা, কিন্তু-” “আচ্ছা, আমার নাম করে বোলো, এখন তার যাওয়া চলবে না। যখন সময় বুঝব তখন যাবার দিন আমিই ঠিক করে দেব ।” নবীন বললে, “তুমি বললে কিনা মেজেবিউকে দেশে পাঠাতে হবে তাই ভাবছি-” মধুসূদন উত্তেজিত হয়ে বললে, “আমি কি বলেছি, এই মুহুর্তেই পাঠিয়ে দিতে হবে ?” নবীন ধীরে ধীরে চলে গেল। মধুসূদন একটা গ্যাসের শিখা জ্বালিয়ে দিয়ে লম্বা কেদারায় ঠেসান দিয়ে বসে রইল। বাড়ির চৌকিদার রাত্রে এক-একবার বাড়ির ঘরগুলোর সামনে দিয়ে টহলিয়ে আসে। মধুসূদনের অল্প একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল, এমন সময় হঠাৎ চমকিয়ে উঠে দেখে চৌকিদার ঘরে ঢুকে লণ্ঠন তুলে ধরে তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। হয়তো সে ভাবছিল, মহারাজ মূৰ্ছাই গেছে, না মারাই গেছে। মধুসূদন লজ্জিত হয়ে ধড়ফড় করে চৌকি থেকে উঠে পড়ল। বাইরের আপিসঘরে বসে সদ্যোবিবাহিত রাজাবাহাদুরের রাত্রিযাপনের শোকাবহ দৃশ্যটা চৌকিদারের কাছে যে অসম্মানকর এ কথাটা মুহুর্তেই তাকে যেন মারলে। উঠেই কিছু রাগের স্বরে চৌকিদারকে বললে, “ঘর বন্ধ করো।” যেন ঘর বন্ধ না থাকাটাতে তারই অপরাধ ছিল। দেউড়ির ঘণ্টাতে বাজল দুটাে । মধুসূদন ঘর ছেড়ে যাবার আগে একবার তার দেরাজ খুললে। ইতস্তত করতে করতে কুমুর নামের প্রশ্নটি পুত্র অন্তঃপুরে দিতে চলে গেল। তােলার এবার সােল সামেন ক্সিগণ। द्र |