পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WOʻGAVe রবীন্দ্র-রচনাবলী এর পরে কিছুতেই মধুসূদন বলতে পারলে না যে চিঠি এসেছে। ধা করে বলে ফেললে, “না, চিঠি তো নেই ।” এই ঘরটার মধ্যে রাত্রে দুজনে এমন করে বসে থাকতে কুমুর সংকোচ বোধ হল । সে যখন উঠব-উঠব করছে, মধুসূদন হঠাৎ বলে উঠল, “বড়োবাউ, আমার উপর রাগ কোরো না।” : এ তো প্রভুর উপরোধ নয়, এ যে প্রণয়ীর মিনতি, আর তার মধ্যে যেন আছে। অপরাধীর আত্মগ্ননি। কুমু বিস্মিত হয়ে গেল, তার মনে হল এ দৈবেরই লীলা। কেননা, সে যে দিনের বেলা বার বার নিজেকে বলেছে, “তুই রাগ করিস নে ৷” সেই কথাটাই আজ অর্ধরাত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে কে মধুসূদনকে দিয়ে বলিয়ে নিলে। মধুসূদন আবার তাকে বললে, “তুমি কি এখনো আমার উপর রাগ করে আছ ?” কুমু বললে, “না, আমার রাগ নেই, একটুও না।” মধুসূদন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল। ও যেন মনে মনে কথা কইছে ; অনুদ্দিষ্ট কারও সঙ্গে যেন ওর কথা । মধুসূদন বললে, “তা হলে এ-ঘর থেকে এসো তোমার আপনি ঘরে।” কুমু আজ রাত্রে প্রস্তুত ছিল না । ঘুমের থেকে জেগে উঠেই হঠাৎ মনকে বেঁধে তোলা কঠিন। কাল সকালে স্নান করে দেবতার কাছে তার প্রতিদিনের প্রার্থনা-মন্ত্র পড়ে তবে কাল থেকে সংসারে তার সাধনা আরম্ভ হবে এই সংকল্প সে করেছিল । তখন ওর মনে হল, “ঠাকুর আমাকে সময় দিলেন না, আজ এই গভীর রাত্রেই ডাক দিলেন । তাকে কেমন করে বলব যে, “না” ” মনের ভিতরে যে একটা প্ৰকাণ্ড অনিচ্ছা হচ্ছিল তাকে অপরাধ বলে কুমু ভয় পেলে । এই অনিচ্ছার বাধা তাকে টেনে রাখছিল বলেই কুমু জোরের সঙ্গে উঠে দাড়ালে, বললে, “চলো।” উপরে উঠে তার শোবার ঘরের সামনে একটু থমকে দাড়িয়ে সে বললে, “আমি এখনই আসছি, দেরি করব না ।” বলে ছাদের কোণে গিয়ে বসে পড়ল। কৃষ্ণপক্ষের খণ্ড চাদ তখন মধ্য-আকাশে । নিজের মনে মনে কুমুবার বার করে বলতে লাগল, “প্ৰভু, তুমি ডেকেছ আমাকে, তুমি ডেকেছি। আমাকে ভোল নি বলেই ডেকেছি। আমাকে কঁাটাপথের উপর দিয়েই নিয়ে যাবে- সে তুমিই, সে তুমিই, সে আর কেউ নয়।” আর-সমস্তকেই কুমু লুপ্ত করে দিতে চায়। আর-সমস্তই মায়া, আর-সমস্তই যদি কঁাটাও হয় তবু সে পথেরই কাটা, আর সে তারই পথের কাটা । সঙ্গে পাথেয় আছে, তার দাদার আশীর্বাদ । সেই আশীৰ্বাদ সে যে আঁচলে বেঁধে নিয়েছে। সেই আঁচলে-বাধা আশীর্বাদ বার বার মাথায় ঠেকালে । তার পরে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রণাম করলে। এমন সময় হঠাৎ চমকে উঠল, পিছন থেকে মধুসূদন বলে উঠল, “বড়োবাউ, ঠাণ্ডা লাগবে, ঘরে এসো ।” অন্তরের মধ্যে কুমু যে বাণী শুনতে চায় তার সঙ্গে এ কষ্ঠের সুর তো মেলে না ! এই তো তার পরীক্ষা, ঠাকুর আজ তাকে বঁাশি দিয়েও ডাকবেন না। তিনি রইবেন আজ ছদ্মবেশে । VOV) যেখানে কুমু ব্যক্তিগত মানুষ সেখানে যতই তার মন ধিক্কারে ঘূণায় বিতৃষ্ণায় ভরে উঠছে, যতই তার সংসার সেখানে আপন গায়ের জোরের রূঢ় অধিকার তাকে অপমানিত করছে ততই সে আপনার চারি দিকে একটা আবরণ তৈরি করছে। এমন একটা আবরণ যাতে করে নিজের কাছে তার ভালো-লাগা মন্দা-লাগার সত্যতাকে লুপ্ত করে, অর্থাৎ নিজের সম্বন্ধে নিজের চৈতন্যকে কমিয়ে দেয় । এ হচ্ছে ক্লোরোফর্মের বিধান। কিন্তু এ তো দু-তিন ঘণ্টার ব্যবস্থা নয়, সমস্ত দিনরাত্ৰি বেদনাবোধকে