পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ○br@ VA এতদিন মধুসূদনের জীবনযাত্রায় কখনো কোনো খেই ছিড়ে যেত না। প্রতি দিনের প্রতি মুহুর্তই নিশ্চিত নিয়মে বাধা ছিল । আজ হঠাৎ একটা অনিশ্চিত এসে সব গোলমাল বাধিয়ে দিয়েছে। এই-যে আজ আপিস থেকে বাড়ির দিকে চলেছে, রাত্তিরটা যে ঠিক কী ভাবে প্রকাশ পাবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত । মধুসূদন ভয়ে ভয়ে বাড়িতে এল, আস্তে আস্তে আহার করলে। আহার করে তখনই সাহস হল না শোবার ঘরে যেতে । প্রথমে কিছুক্ষণ বাইরের দক্ষিণের বারান্দায় পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। শোবার সময় নটা যখন বাজল তখন গেল অন্তঃপুরে। আজ ছিল দৃঢ় পাণ— যথাসময়ে বিছানায় শোবে, কিছুতেই অন্যথা হবে না। শূন্য শোবার ঘরে ঢুকেই মশারি খুলেই একেবারে ঝাপ করে বিছানার উপরে পড়ল। ঘুম আসতে চায় না। রাত্রি যতই নিবিড় হয় ততই ভিতরকার উপবাসী জীবটা অন্ধকারে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে। তখন তাকে তাড়া করবার কেউ নেই, পাহারাওয়ালারা সকলেই ক্লান্ত । ঘড়িতে একটা বাজল, চোখে একটুও ঘুম নেই ; আর থাকতে পারল না, বিছানা থেকে উঠে ভাবতে লাগল কুমু কোথায় ? বন্ধু ফরাশের উপর কড়া হুকুম, ফরাশখানা তালাচাবি দিয়ে বন্ধ। ছাদ ঘুরে এল, কেউ নেই। পায়ের জুতো খুলে ফেলে নীচের তলায় বারান্দা বেয়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগল । মোতির মার ঘরের সামনে এসে মনে হল যেন কথাবার্তার শব্দ । হতে পারে, কাল চলে যাবে, আজ স্বামীশ্ৰীতে পরামর্শ চলছে। বাইরে চুপ করে দরজায় কান পেতে রইল। দুজনে গুনগুন করে আলাপ চলছে। কথা শোনা যায় না, কিন্তু স্পষ্টই বােঝা গুেল দুটিই মেয়ের গলা। তবে তো বিচ্ছেদের পূর্বরাত্রে মোতির মায়ের সঙ্গে কুমুরই মনের কথা হচ্ছে। রাগে ক্ষোভে ইচ্ছে করতে লাগল লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলে একটা কাণ্ড করে। কিন্তু নবীনটা তা হলে কোথায় ? নিশ্চয় বাইরে । অন্তঃপুর থেকে বাইরে যাবার ঝিলমিল-দেওয়া রাস্তােটাতে লণ্ঠনে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে, সেইখানে এসেই মধুসূদন দেখলে একখানা লাল শাল গায়ে জড়িয়ে শ্যামা দাড়িয়ে। তার কাছে লজ্জিত হয়ে মধুসূদন রেগে উঠল। বললে, “কী করছ এত রাত্রে এখানে ?” শ্যামা উত্তর করলে, “শুয়েছিলুম। বাইরে পায়ের শব্দ শুনে ভয় হল, ভাবলুম বুঝি-” মধুসূদন তর্জন করে বলে উঠল, “আস্পর্ধা বাড়ছে দেখছি। আমার সঙ্গে চালাকি করতে চেয়ে না, সাবধান করে দিচ্ছি। যাও শুতে।” শ্যামাসুন্দরী কয়দিন থেকে একটু একটু করে তার সাহসের ক্ষেত্র বাড়িয়ে বাড়িয়ে চলছিল। আজ বুঝলে, অসময়ে অজায়গায় পা পড়েছে। অত্যন্ত করুণ মুখ করে একবার সে মধুসূদনের দিকে চাইলে, তার পরে মুখ ফিরিয়ে আঁচলটা টেনে চােখ মুছলে । চলে যাবার উপক্রম করে আবার সে পিছন ফিরে দাড়িয়ে বলে উঠল, “চালাকি করব না ঠাকুরপো । যা দেখতে পাচ্ছি। তাতে চোখে ঘুম আসে না। আমরা তো আজ আসি নি, কতকালের সম্বন্ধ, আমরা সইব কী করে ?” বলে শ্যামা দ্রুতপদে চলে গেল । মধুসূদন একটুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে রইল, তার পরে চলল বাইরের ঘরে । ঠিক একেবারে পড়ল চৌকিদারের সামনে, সে তখন টাইল দিতে বেরিয়েছে। এমনি নিয়মের কঠিন জাল যে, নিজের বাড়িতে যে চুপি চুপি সঞ্চরণ করবে তার জো নেই। চারিদিকেই সতর্ক দৃষ্টির বৃহ। রাজাবাহাদুর এই রাত্রে বিছানা ছেড়ে খালি-পায়ে অন্ধকারে বাইরের বারান্দায় ভূতের মতো বেরিয়েছে। এ যে একেবারে অভূতপূর্ব ! প্রথমে দূর থেকে যখন চিনতে পারে নি, চৌকিদার বলে উঠেছিল, “কোন হ্যায় ?” কাছে এসে জিভ কেটে মন্ত প্ৰণাম করলে, বললে, “রাজাবাহাদুর, কিছু হুকুম আছে ?” । মধুসূদন বললে, “দেখতে এলুম ঠিকমত চলছে কি না।” কথাটা মধুসূদনের পক্ষে অসংগত নয়। তার পরে মধুসূদন বৈঠকখানাঘরে গিয়ে দেখে যা ভেবেছিল তাই, নবীন বসবার ঘরে গদির উপর তাকিয়া আঁকড়ে নিদ্ৰা দিচ্ছে। মধুসূদন ঘরে একটা গ্যাসের আলো ছেলে দিলে,তাতেও নবীনের ঘুম