পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○brbr রবীন্দ্র-রচনাবলী মধুসূদন একটু কাছে এগিয়ে এসে ধীর স্বরে বললে, “শুতে আসবে না বড়োবউ ?” কুমু আশ্চর্য হয়ে গেল। সে নিশ্চয় মনে করেছিল মধুসূদন রাগ করবে, তাকে অপমানের কথা বলবে । হঠাৎ একটা চিরপরিচিত সুর তার মনে পড়ে গেল— তার বাবা স্নিগ্ধ গলায় কেমন করে তার মাকে বড়োবউ বলে ডাকতেন। সেইসঙ্গেই মনে পড়ল- মা তার বাবাকে কাছে আসতে বাধা দিয়ে কেমন করে চলে গিয়েছিলেন । এক মুহুর্তে তার চোখ ছলছলিয়ে এল- মাটিতে মধুসূদনের পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে উঠল, “আমাকে মাপ করো ।” মধুসূদন তাড়াতাড়ি তার হাত ধরে তুলে চৌকির উপরে বসিয়ে বললে, “কী দোষ করেছ যে তোমাকে করব ?” কর্ম বললে, এখনাে আমার মন তৈরি হয় নি। আমাকে একটুখানি সময় দাও।” মধুসূদনের মনটা শক্ত হয়ে উঠল ; বললে, “কিসের জন্যে সময় দিতে হবে বুঝিয়ে বলে ।” “ঠিক বলতে পারছি নে, কাউকে বুঝিয়ে বলা শক্ত—” মধুসূদনের কণ্ঠে আর রস রইল না। সে বললে, “কিছুই শক্ত না। তুমি বলতে চাও, আমাকে (ऊभा ऊळ ब्लॉकष्ट्र क्षी ॥' কুমুর পক্ষে মুশকিল হল । কথাটা সত্যি অথচ সত্যি নয়। হৃদয় ভরে নৈবেদ্য দেবার জন্যেই সে পণ করে আছে, কিন্তু সে নৈবেদ্য এখনো এসে পৌঁছোল না । মন বলছে, একটু সবুর করলেই, পথে বাধা না দিলে, এসে পৌছােবে ; দেরি যে আছে তাও না। তবুও এখনো ডালা যে শূন্য সে কথা মানতেই হবে । কুমু বললে, “তোমাকে ফাকি দিতে চাই নে বলেই বলছি, একটু আমাকে সময় দাও।” মধুসূদন ক্রমেই অসহিষ্ণু হতে লািগল— কড়া করেই বললে, “সময় দিলে কী সুবিধে হবে! তোমার দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে স্বামীর ঘর করতে চাও !” মধুসূদনের তাই বিশ্বাস । সে ভেবেছে বিপ্রদাসের অপেক্ষাতেই কুমুর সমস্ত ঠেকে আছে। দাদা যেমনটি চালাবে, ও তেমনি চলবে । বিদ্যুপের সুরে বললে, “তোমার দাদা তোমার গুরু !” কুমুদিনী তখনই মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “হ্যা, আমার দাদা আমার গুরু ।” “র্তার হুকুম না হলে আজ কাপড় ছাড়বে না, বিছানায় শুতে আসবে না ! তাই নাকি ?” কুমুদিনী হাতের মুঠো শক্ত করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল । “তা হলে টেলিগ্রাফ করে হুকুম আনাই— রাত অনেক হল ।” কুমু কোনো জবাব না দিয়ে ছাতে যাবার দরজার দিকে চলল । মধুসূদন গর্জন করে ধমকে উঠে বললে, “যেয়ো না বলছি।” । কুমু তখনই ফিরে দাড়িয়ে বললে, “কী চাও বলে ।” । “এখনই কাপড় ছেড়ে এসো।” ঘড়ি খুলে বললে, “পাচ মিনিট সময় দিচ্ছি।” কুমু তখনই নাবার ঘরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে শাড়ির উপর একখানা মোটা চাদর জড়িয়ে চলে এল । এখন দ্বিতীয় হুকুমের জন্যে তার অপেক্ষা । মধুসূদন দেখে বেশ বুঝলে এও রণসাজ । রাগ বেড়ে উঠল, কিন্তু কী করতে হবে ভেবে পায় না। প্রবল ক্রোধের মুখেও মধুসূদনের মনে ব্যবস্থাবুদ্ধি থাকে ; তাই সে থমকে গেল। বললে, “এখন কী করতে চাও আমাকে বলো।” “তুমি যা বলবে তাই করব ।” মধুসূদন হতাশ হয়ে বসে পড়ল চৌকিতে । ঐ চাদরে-জড়ানো মেয়েটিকে দেখে মনে হল, এ যেন বিধবার মূর্তি- ওর স্বামী আর ওর মাঝখানে যেন একটা নিস্তব্ধ মৃত্যুর সমুদ্র। তর্জন করে এ সমুদ্র পার হওয়া যায় না। পালে কোন হাওয়া লাগলে তরী ভাসবে ? কোনো দিন কি ভাসবে ? চুপ করে বসে রইল। ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া ঘরে একটুও শব্দ নেই। কুমুদিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না- আবার ফিরে বাইরে ছাতের অন্ধকারের দিকে চােখ মেলে ছবির মতো দাড়িয়ে রইল। রাস্তার মােড় থেকে একটা মাতালের গদগদ কণ্ঠের গানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, আর