পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8の総 মধুসূদন সংগীতের রস বোঝে না, কিন্তু কুমুর বিশ্ববিস্মৃত মুখের উপর যে সুর খেলছিল, এসরাজের পর্দায় পর্দায় কুমুর আঙুল-ছোয়ার যে ছন্দ নেচে উঠছিল তাই তার বুকে দোল দিলে, মনে হতে লাগল ওকে যেন কে বরদান করছে। আনমনে বাজাতে বাজাতে কুমুহঠাৎ এক সময়ে দেখতে পেল মধুসূদন তার মুখের উপর একদৃষ্টি চেয়ে, অমনি হাত গেল থেমে, লজ্জা এল, বাজনা বন্ধ করে দিলে। মধুসূদনের মন দাক্ষিণ্যে উদবেল হয়ে উঠল, বললে, “বড়োবউ, তুমি কি চাও বলো।” কুমু যদি বলত, কিছুদিন দাদার সেবা করতে চাই, মধুসূদন তাতেও রাজি হতে পারত ; কেননা আজ কুমুর গীতমুগ্ধ মুখের দিকে কেবলই চেয়ে চেয়ে সে নিজেকে বলছিল, “এই তো আমার ঘরে এসেছে, এ কী আশ্চর্য সত্য !” কুমু এসরাজ মাটিতে রেখে, ছড়ি ফেলে চুপ করে রইল। মধুসূদন আর-একবার অনুনয় করে বললে, “বড়োবাউ, তুমি আমার কাছে কিছু চাও। যা চাও তাই পাবে ।” ፵፡ কুমু বললে, “মুরলী বেয়ারাকে একখানা শীতের কাপড় দিতে চাই।” কুমু যদি বলত কিছু চাই নে, সেও ছিল ভালো, কিন্তু মুরলী বোহারার জন্যে গায়ের কম্বল ! যে দিতে পারে মাথার মুকুট, তার কাছে চাওয়া জুতোর ফিতে ! মধুসূদন অবাক । রাগ হল বেহারটার উপর। বললে, “লক্ষ্মীছাড়া মুরলী বুঝি তোমাকে বিরক্ত করছে ?” “না, আমি আপনিই ওকে একটা আলোয়ান দিতে গেলুম, ও নিল না। তুমি যদি হুকুম কর। তবে সাহস করে নেবে ।” মধুসূদন স্তব্ধ হয়ে রইল। খানিক পরে বললে, “ভিক্ষে দিতে চাও ! আচ্ছা দেখি, কই তোমার আলোয়ান ?” কুমু তার সেই অনেক দিনের পরা বাদামি রঙের আলোয়ান নিয়ে এল। মধুসূদন সেটা নিয়ে নিজের গায়ে জড়াল। টিপায়ের উপরকার ছোটাে ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে একজন বুড়ি দাসী এল ; তাকে বললে, “মুরলী বোহারাকে ডেকে দাও।” । মুরলী এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল ; শীতে ও ভয়ে তার জোড়া হাত কঁপিছে। । “তোমার মাজি তোমাকে বকশিশ দিয়েছেন” বলে মধুসূদন পকেট-কেস থেকে একশো টাকার একটা নোট বের করে তার ভাজ খুলে সেটা দিলে কুমুর হাতে। এরকম অকারণে অযাচিত দান মধুসূদনের দ্বারা জীবনে কখনো ঘটে নি। অসম্ভব ব্যাপারে মুরলী বেহারিার ভয় আরো বেড়ে উঠল, দ্বিধাকম্পিত স্বরে বললে, “হুজুর-” দুখঃ ৰে বেটা। বােকা, নে তাের মায়ের হাত থেকে। এই টাকা দিয়ে যত খুশি গরম কাপড় ব্যাপারটা এইখানে শেষ হল- সেইসঙ্গে সেদিনকার আর-সমস্তই যেন শেষ হয়ে গেল । যে স্রোতে কুমুর মন ভেসেছিল। সে গেল। হঠাৎ বন্ধ হয়ে, মধুসূদনের মনে আত্মত্যাগের যে ঢেউ চিত্তসংকীর্ণতার কুল ছাপিয়ে উঠেছিল তাও সামান্য বেহারার জন্য তুচ্ছ প্রার্থনায় ঠেকে গিয়ে আবার তলায় গেল নেমে । এর পরে সহজে কথাবার্তা কওয়া দুই পক্ষেই অসাধ্য। আজ সন্ধের সময় সেই । তালুক-কেনা ব্যাপার নিয়ে লোক এসে বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে, এ কথাটা মধুসূদনের মনেই ছিল না। এতক্ষণ পরে চমকে উঠে ধিক্কার হল নিজের উপরে | উঠে দাড়িয়ে বললে, “কাজ আছে, আসি ।” দ্রুত চলে গেল । । r পথের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর ঘরের সামনে এসে বেশ প্রকাশ্য কণ্ঠস্বরেই বললে, “ঘরে আছ?” । শ্যামসুন্দরী আজ খায় নি ; একটা র্যাপার মুড়ি দিয়ে মেজেয় মাদুরের উপর অবসন্ন ভাবে শুয়েছিল। মধুসূদনের ডাক শুনে তাড়াতাড়ি দরজার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে, “কী ঠাকুরপো ?” “পান দিলে না। আমাকে ?” a