পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 S SR রবীন্দ্র-রচনাবলী ভালোবেসেছ ? ভালোবাসা কাকে বলে তুমি কি জান ?” “যদি বলি জানি, তুমি হাসবে । সূর্য ওঠবার আগে যেমন আলো হয় আমার সমস্ত আকাশ ভরে ভালোবাসা তেমনি করেই জেগেছিল। কেবলই মনে হয়েছে সূৰ্য উঠল বলে। সেই সূর্যোদয়ের কল্পনা মাথায় করেই আমি বেরিয়েছি, তীর্থের জল নিয়ে- ফুলের সাজি সাজিয়ে । যে দেবতাকে এতদিন সমস্ত মন দিয়ে মেনে এসেছি, মনে হয়েছে তার উৎসাহ পেলুম। যেমন করে অভিসারে বেরোয় তেমনি করেই বেরিয়েছি। অন্ধকার রাত্রিকে অন্ধকার বলে মনেই হয় নি, আজ আলোতে চােখ মেলে অন্তরেই বা কী দেখলুম, বাইরেই বা কী দেখছি! এখন বছরের পর বছর, মুহুর্তের পর মুহুর্ত কাটবে কী করে ?” “তুমি কি বড়োঁঠাকুরকে ভালোবাসতে পারবে না মনে করা ?” “পারতুম ভালোবাসতে । মনের মধ্যে এমন-কিছু এনেছিলুম যাতে সবই পছন্দমত করে নেওয়া সহজ হত । গোড়াতেই সেইটেকে তোমার বড়েঠাকুর ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। আজ সব জিনিস কড়া হয়ে আমাকে বাজছে। আমার শরীরের উপরকার নরম ছালটাকে কে যেন ঘষড়ে তুলে দিল, তাই চারি দিকে সবই আমাকে লাগছে, কেবলই লাগছে, যা-কিছু ছুই তাতেই চমকে উঠি ; এর পরে কড়া পড়ে গেলে কোনো একদিন হয়তো সয়ে যাবে, কিন্তু জীবনে কোনোদিন আর আনন্দ পাব कों (७ों |” “বলা যায় না ভাই ।” - “খুব বলা যায় । আজ আমার মনে একটুমাত্র মোহ নেই। আমার জীবনটা একেবারে নির্লজের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। নিজেকে একটু ভোলাবার মতো আড়াল কোথাও বাকি রইল না । মরণ ছাড়া মেয়েদের কি আর কোথাও নড়ে বসবার একটুও জায়গা নেই ? তাদের সংসারটাকে নিষ্ঠুর বিধাতা এত আঁট করেই তৈরি করেছে ?” এতক্ষণ ধরে এমনতরো উত্তেজনার কথা কুমুর মুখে মোতির মা আর-কোনোদিন শোনে নি। বিশেষ করে আজ যেদিন বড়োঁঠাকুরকে ওরা কুমুর প্রতি এতটা প্ৰসন্ন করে এনেছে, সেইদিনই কুমুর এই তীব্ৰ অধৈৰ্য দেখে মোতির মা ভয় পেয়ে গেল। বুঝলে লতার একেবারে গোড়ায় ঘা লেগেছে, উপর থেকে অনুগ্রহের জল ঢেলে মালী আর একে তাজা করে তুলতে পারবে না। একটু পরে কুমু বলে উঠল, “জানি, স্বামীকে এই যে শ্রদ্ধার সঙ্গে আত্মসমৰ্পণ করতে পারছি নে এ আমার মহাপাপ । কিন্তু সে পাপেও আমার তেমন ভয় হচ্ছে না। যেমন হচ্ছে শ্রদ্ধাহীন আত্মসমর্পণের গ্লানির কথা মনে করে ।” মোতির মা কোনো উত্তর না ভেবে পেয়ে হতবুদ্ধির মতো বসে রইল। একটু চুপ করে থেকে কুমু বললে, “তোমার কত ভাগ্যি ভাই, কত পুণ্য করেছিলে, ঠাকুরপোকে এমন সমস্ত মনটা দিয়ে ভালোবাসতে পেরেছ। আগে মনে করতুম, ভালোবাসাই সহজ- সব স্ত্রী সব স্বামীকে আপনিই ভালোবাসে। আজ দেখতে পাচ্ছি। ভালোবাসতে পারাটাই সব চেয়ে দুর্লভ, জন্মজন্মান্তরের সাধনায় ঘটে । আচ্ছা ভাই, সত্যি বলে সব স্ত্রীই কি স্বামীকে ভালোবাসে ?” মুরুমা একটু হেসে বললে,”ভালাে না বাসলেও ভালাে স্ত্রী হওয়া যায়, নইলে সংসার চলবে করে ?” সেইটেই কঠিন সাধনা ৷” । “বাইরে থেকে তাতেও বাধা পড়ে।” “অন্তর থেকে সে বাধা কাটিয়ে উঠতে পারা যায়। আমি পারব, আমি হার মানব না ।” “তুমি পারবে না তো কে পারবে ?” বৃষ্টি জোর করে চেপে এল। বাতাসে ল্যাম্পের আলো থেকে থেকে চকিত হয়ে ওঠে । দমকা হাওয়া যেন একটা ভিজে নিশাচর পাখির মতাে পাখা ঝাপটে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কুমুর শরীরটা