পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8S পৌঁছোল। আজ নীেকোটা ডাঙায় তুলে ফুটােগুলোর বিচার করবার বেলায়, যারা নিরাপদে এসেছে ঘাটে, তাদের গা শিউরে উঠছে। এমনতরো টুকরো সমালোচনা নিয়ে আনাড়িদের ধাধা লাগানো সহজ। সাধারণত আনাড়িদের সুবিধে এই যে, তারা লাভ করতে চায়, বিচার করতে চায় না। কিন্তু যদি দৈবাৎ বিচার করতে বসে। তবে মারাত্মক হয়ে ওঠে । এই সব বোকাদের উপর মধুসূদনের নিরতিশয় অবজ্ঞা-মিশ্ৰিত ক্রোধের উদয় হল । কিন্তু বোকাদের যেখানে প্রাধান্য সেখানে তাদের সঙ্গে রফা করা ছাড়া গতি নেই। জীৰ্ণ মই মাচু মচু করে, দোলে, ভাঙার ভয় দেখায়, যে ব্যক্তি উপরে চড়ে তাকে এই পায়ের তলার অবলম্বনটাকে বঁচিয়ে চলতেই হয় । রাগ করে লাথি মারতে ইচ্ছে করে, তাতে মুশকিল আরো বাড়বারই কথা । শাবকের বিপদের সম্ভাবনা দেখলে সিংহিনী নিজের আহারের লোভ ভুলে যায়, ব্যাবসা সম্বন্ধে মধুসূদনের সেইরকম মনের অবস্থা। এ যে তার নিজের সৃষ্টি ; এর প্রতি তার যে দরদ সে প্রধানত টাকার দরদ নয় । যার রচনাশক্তি আছে, আপন রচনার মধ্যে সে নিজেকেই নিবিড় করে পায়, সেই পাওয়াটা যখন বিপন্ন হয়ে ওঠে তখন জীবনের আর-সমস্ত সুখদুঃখকামনা তুচ্ছ হয়ে যায়। কুমু মধুসূদনকে কিছুদিন থেকে প্রবল টানে টেনেছিল, সেটা হঠাৎ আলগা হয়ে গেল। জীবনে ভালোবাসার প্রয়োজনটা মধুসূদন প্রৌঢ় বয়সে খুব জোরের সঙ্গে অনুভব করেছিল। এই উপসর্গ যখন অকালে দেখা দেয় তখন উদ্দাম হয়েই ওঠে। মধুসূদনকে ধাক্কা কম লাগে নি, কিন্তু আজ তার বেদনা গেল কোথায় ? নবীন ঘরে আসতেই মধুসূদন জিজ্ঞাসা করলে, “আমার প্রাইভেট জমােখরচের খাতা বাইরের কোনো লোকের হাতে পড়েছে কি, জান ?” নবীন চমকে উঠল, বললে, “সে কী কথা ?” “তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে খাতাঞ্জির ঘরে কেউ আনাগোনা করছে কি না ।” “রতিকান্ত বিশ্বাসী লোক, সে কি কখনো-” “তার অজান্তে মুহুরিদের সঙ্গে কেউ কথা চালাচালি করছে বলে সন্দেহের কারণ ঘটেছে। খুব সাবধানে খবরটা জানা চাই কারা এর মধ্যে আছে ।” - চাকর এসে খবর দিলে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। মধুসূদন সে কথায় মন না দিয়ে নবীনকে বললে, “শীঘ্ৰ আমার গাড়িটা তৈরি করে আনতে বলে দাও।” নবীন বললে, “ খেয়ে বেরোবে না ? রাত হয়ে আসছে।” “বাইরেই খাব, কাজ আছে।” নবীন মাথা হেঁট করে ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এল। সে যে কৌশল করেছিল ফেসে গেল বুঝি । হঠাৎ মধুসূদন নবীনকে ফিরে ডেকে বললে, “এই চিঠিখানা কুমুকে দিয়ে এসো।” নবীন দেখলে বিপ্ৰদাসের চিঠি । বুঝলে এ চিঠি আজ সকালেই এসেছে, সন্ধেবেলায় নিজের হাতে কুমুকে দেবে বলে মধুসূদন রেখেছিল। এমনি করে প্রত্যেকবার মিলন উপলক্ষে একটা-কিছু অর্ঘ্য হাতে করে আনবার ইচ্ছে। আজ আপিসের কাজে হঠাৎ তুফান উঠে তার এই আদরের আয়োজনটুকু গৈল ডুবে । , মাদ্রাজে যে ব্যাঙ্ক ফেল করেছে সেটার উপরে সাধারণের নিশ্চিত আস্থা ছিল । তার সঙ্গে ঘোষাল-কোম্পানির যে যোগ সে সম্বন্ধে অধ্যক্ষদের বা অংশীদারদের কারও মনে কিছুমাত্ৰ সংশয় ছিল না। যেই কল বিগড়ে গেল অমনি অনেকেই বলাবলি করতে আরম্ভ করলে যে, আমরা গােড়া থেকেই ঠাউরেছিলুম, ইত্যাদি । সাংঘাতিক আঘাতের সময় ব্যাবসাকে যখন একজোট হয়ে রক্ষার চেষ্টা দরকার, সেই সময়েই পরাজয়ের সম্বন্ধে দোষারোপ প্রবল হয়ে ওঠে এবং যাদের প্রতি কারও ঈর্ষা আছে তাদেরকে অপদস্থ করবার চেষ্টায় টলমলে ব্যাবসাকে কাত করে ফেলা হয়। সেইরকম চেষ্টা চলবে মধুসূদন তা বুঝেছিল । মাদ্রাজ-ব্যাঙ্কের বিপর্যয়ে ঘোষাল-কোম্পানির লোকসানের পরিমাণ যে কতটা দাড়াবে