পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8 SV) সোডা-ওয়াটারের বোতল, একখানা বেত-ছোড়া চৌকি, গোটকতক ময়লা তোয়ালে এবং গেঞ্জি । শেলফের উপর বইগুলো ঠিকমত সাজালে, দাদার হাতের কাছাকাছি একখানি টিপাই সরিয়ে এনে তার উপরে গুছিয়ে রাখলে পড়বার বই, কলমদান, ব্লটিংপ্যাড, খাবার জলের কাচের সোরাই আর গেলাস, ছোটাে একটি আয়না এবং চিরুনি বুশ । ইতিমধ্যে গোকুল একটা পিতলের জগে গরম জল, একটা পিতলের চিলমচি, আর সাফ তোয়ালে বেতের মোড়ার উপর এনে রাখলে । কিছুমাত্র সম্মতির অপেক্ষা না রেখে কুমু গরম জলে তোয়ালে ভিজিয়ে বিপ্রদাসের মুখ-হাত মুছিয়ে দিয়ে তার চুল আঁচড়িয়ে দিলে, বিপ্রদাস শিশুর মতো চুপ করে সহ্য করল । কখন কী ওষুধ খাওয়াতে হবে এবং পথ্যের নিয়ম কী সমস্ত জেনে নিয়ে এমন ভাবে গুছিয়ে বসল যেন ওর জীবনে আর কোথাও কোনাে দায়িত্ব নেই। বিপ্ৰদাস মনে মনে ভাবতে লাগল এর অর্থটা কী ? ভেবেছিল, দেখা করতে এসেছে আবার চলে যাবে, কিন্তু সেরকম ভাব তো নয়। শ্বশুরবাড়িতে কুমুর সম্বন্ধটা কী রকম দাড়িয়েছে সেটা বিপ্রদাস জানতে চায়, কিন্তু স্পষ্ট করে প্রশ্ন করতে সংকোচ বোধ করে। কুমুর নিজের মুখ থেকেই শুনবে এই আশা করে রইল। কেবল আস্তে আস্তে একবার জিজ্ঞাসা করলে, “আজ তোকে কখন যেতে হবে ?” কুমু বললে, “আজ যেতে হবে না।” বিপ্ৰদাস বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, “এতে তোর শ্বশুরবাড়িতে কোনো আপত্তি নেই ?” “না, আমার স্বামীর সম্মতি আছে।” বিপ্রদাস চুপ করে রইল। কুমু ঘরের কোণের টেবিলটাতে একটা চাদর বিছিয়ে দিয়ে তার উপর ওষুধের শিশি বোতল প্রভৃতি গুছিয়ে রাখতে লাগল। খানিকক্ষণ পরে বিপ্রদাস জিজ্ঞাসা করলে, “তোকে কি তবে কাল যেতে হবে ?” “না, এখন আমি কিছুদিন তোমার কাছে থাকব ।” টম কুকুরটা কীেচের নীচে শান্ত হয়ে নিদ্রার সাধনায় নিযুক্ত ছিল, কুমু তাকে আদর করে তার গ্ৰীতি-উচ্ছাসকে অসংযত করে তুললে । সে লাফিয়ে উঠে কুমুর কোলের উপরে দুই পা তুলে কলভাষায় উচ্চস্বরে আলাপ আরম্ভ করে দিলে। বিপ্রদাস বুঝতে পারলে কুমু হঠাৎ এই গোলমালটা সৃষ্টি করে তার পিছনে একটু আড়াল করলে আপনাকে । খানিক বাদে কুকুরের সঙ্গে খেলা বন্ধ করে কুমু মুখ তুলে বললে, “দাদা, তোমার বার্লি খাবার সময় হয়েছে, এনে দিই ।” “না সময় হয় নি” বলে কুমুকে ইশারা করে বিছানার পাশের চৌকিতে বসালে। আপনার হাতে তখনই কুমু কিছু বলতে পারলে না। মাথা নিচু করে বসে রইল, দেখতে দেখতে মুখ হল। লাল, শিশুকালের মতো করে বিপ্রদাসের প্রশস্ত বুকের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল ; বললে, “দাদা, আমি সবই ভুল বুঝেছি, আমি কিছুই জানতুম না ।” বিপ্রদাস আস্তে আস্তে কুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিল। খানিক বাদে বললে, “আমি তোকে ঠিকমত শিক্ষা দিতে পারি নি। মা থাকলে তোকে তোর শ্বশুরবাড়ির জন্যে প্রস্তুত করে দিতে পারতেন।” কুমু বললে, “আমি বরাবর কেবল তোমাদেরই জানি, এখান থেকে অন্য জায়গা যে এত বেশি তফাত তা আমি মনে করতে পারতুম না। ছেলেবেলা থেকে আমি যা-কিছু কল্পনা করেছি। সব তোমাদেরই ছাচে । তাই মনে একটুও ভয় হয় নি। মাকে অনেক সময়ে বাবা কষ্ট দিয়েছেন জানি, কিন্তু সে ছিল দুরন্তপিনা, তার আঘাত বাইরে, ভিতরে নয়। এখানে সমস্তটাই অন্তরে অন্তরে আমার যেন অপমান ।” ክ বিপ্রদাস কোনো কথা না বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। মধুসূদন যে ওদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক জগতের মানুষ, তা সেই বিবাহ-অনুষ্ঠানের আরম্ভ থেকেই বুঝতে পেরেছে। তারই বিষম উদবেগে ওর শরীর যেন কোনােমতেই সুস্থ হয়ে উঠছে না। এই দিঙনাগের