পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ 8 && কাছে এসে বসে নি ; কী জানি কাল রাত্রে নিজেকে ধরা দেবার পরে মধুসূদন নিজের উপর পাছে বিরক্ত হয়ে থাকে। খাবার পর মধুসূদন শূন্য শেবার ঘরে এসে একটুখানি চুপ করে থাকল, তার পরে নিজেই শ্যামাকে ডেকে পাঠালে। শ্যামা লাল রঙের একটা বিলিতি শাল গায়ে দিয়ে যেন একটু সংকুচিতভাবে ঘরে ঢুকে একধারে নতনেত্রে দাড়িয়ে রইল। মধুসূদন ডাকলে, “এসো, এইখানে এসো, বসো ।” শ্যামা শিয়রের কাছে বসে “তোমাকে যে বড়ো রোগা দেখাচ্ছে আজ” বলে একটু ঝুকে পড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মধুসূদন বললে, “আঃ, তোমার হাত বেশ ঠাণ্ডা।” রাত্রে মধুসূদন যখন শুতে এল শ্যামাসুন্দরী অনাহূত ঘরে ঢুকে বললে, “আহা, তুমি একলা ৷” শ্যামাসুন্দরী একটু যেন স্পর্ধার সঙ্গেই কোনো আর আবরণ রাখতে দিলে না। যেন অসংকোচে সবাইকে সাক্ষী রেখেই ও আপনার অধিকার পাকা করে তুলতে চায়। সময় বেশি নেই, কবে। আবার কুমু এসে পড়বে, তার মধ্যে দখল সম্পূর্ণ হওয়া চাই। দখলটা প্রকাশ্য হলে তার জোর আছে, কোনোখানে লজ্জা রাখলে চলবে না। অবস্থাটা দেখতে দেখতে দাসীচাকরীদের মধ্যেও জানাজানি হল। মধুসূদনের মনে বহুকালের প্রবৃত্তির আগুন যতবড়ো জোরে চাপা ছিল, ততবড়ো জোরেই তা অবারিত হল, কাউকে কেয়ার করলে না, মত্ততা খুব স্থূলভাবেই সংসারে প্রকাশ করে দিলে। নবীন মেতির মা দুজনেই বুঝলে এ বান আর ঠেকানো যাবে না। “দিদিকে কি ডেকে আনবে না ? আর কি দেরি করা ভালো ?” “সেই কথাই তো ভাবছি। দাদার হুকুম নইলে তো উপায় নেই। দেখি চেষ্টা করে।” যেদিন সকালে কৌশলে দাদার কাছে কথাটা পাড়বে বলে নবীন এল, দেখে যে দাদা বেরোবার জন্যে প্ৰস্তুত, দরজার কাছে গাড়ি তৈরি । নবীন জিজ্ঞাসা করলে, “কোথায় বেরোচ্ছ নাকি ?” মধুসূদন একটু সংকোচ কাটিয়ে বললে, “সেই গনৎকার বেঙ্কটস্বামীর কাছে।” নবীনের কাছে দুর্বলতা চাপা রাখতেই চেয়েছিল। হঠাৎ মনে হল ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলেই সুবিধা হতে পারে । তাই বললে, “চলে আমার সঙ্গে ।” নবীন ভাবলে, সর্বনাশ । বললে, “দেখে আসি গে। সে বাড়িতে আছে কি না । আমার তো বোধ হচ্ছে সে দেশে চলে গেছে, অন্তত সেইরকম তো কথা ।” মধুসূদন বললে, “তা বেশ তো, দেখে আসা যাক-না।” নবীন নিরুপায় হয়ে সঙ্গে চলল, কিন্তু মনে মনে প্ৰমাদ গনলে । গনৎকারের বাড়ির সামনে গাড়ি দাড়াতেই নবীন তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে একটু উকি মেরেই বললে, “বোধ হচ্ছে কেউ যেন বাড়িতে নেই।” যেমন বলা, সেই মুহুর্তেই স্বয়ং বেঙ্কটস্বামী দাঁতন চিবোতে চিবোতে দরজার কাছে বেরিয়ে এল। নবীন দ্রুত তার গা ঘেঁষে প্ৰণাম করে বললে, “সাবধানে কথা কবেন ।” সেই ঐদো ঘরে তক্তপোশে সবাই বসল। নবীন বসল মধুসূদনের পিছনে। মধুসূদন কিছু বলবার সংগঠন বলে কল, “মহারাজের সময় বড়ো খারাপ যাচ্ছে, কবে গ্রহশান্তি হবে বলে দাও " মধুসূদন নবীনের এই ফাস-করে-দেওয়া প্রশ্নে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে তার উরুতে খুব একটা টিপনি দিলে । বেঙ্কটস্বামী রাশিচক্ৰ কেটে একেবারে স্পষ্টই দেখিয়ে দিলে মধুসূদনের ধনস্থানে শনির দৃষ্টি পড়েছে। গ্রহের নাম জেনে মধুসূদনের কোনো লাভ নেই, তার সঙ্গে বোঝাপড়া করা শক্ত। যে যে মানুষ ওর সঙ্গে শক্রিতা করছে স্পষ্ট করে তাদেরই পরিচয় চাই, বর্ণমালার যে বর্গেই পড়ুক নাম বের করতে