পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8७२ রবীন্দ্র-রচনাবলী দিতে পারব না। তারা আবার দু লাখ টাকা আগাম সুদ হিসেবে কেটে নেবে। তার উপর দালালি আছে ।” বিপ্রদাস বললে, “আচ্ছা, আসুক সুবোধ । কিন্তু আসবে তো ?” “যতবড়ো সাহেব হােক-না, তোমার তার পেলে সে না এসে থাকতে পারবে না। সে তুমি নিশ্চিন্ত থাকে । কিন্তু দাদা, আর দেরি করা নয়, খুকিকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দাও।” বিপ্রদাস খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, বললে, “মধুসূদন না ডেকে পাঠালে যাবার বাধা আছে।” “কেন, খুকি কি মধুসূদনের পাটখােটা মজুর ? নিজের ঘরে যাবে তার আবার হুকুম কিসের ?” আহার সেরে নবীন একলা এল বিপ্রদাসের ঘরে । বিপ্রদাস বললে, “কুমু তোমাকে স্নেহ করে।” নবীন বললে, “তা করেন । বোধ করি আমি অযোগ্য বলেই ওঁর স্নেহ এত বেশি ।” “র্তার সম্বন্ধে তোমাকে কিছু বলতে চাই, তুমি আমাকে কোনো কথা লুকিয়ে না।” “কোনো কথা আমার নেই যা আপনাকে বলতে আমার বাধবে ।” “কুমু যে এখানে এসেছে আমার মনে হচ্ছে তার মধ্যে যেন বঁাকা কিছু আছে।” “আপনি ঠিকই বুঝেছেন । র্যার অনাদর কল্পনা করা যায় না। সংসারে তীরও অনাদর ঘটে ।” “অনাদর ঘটেছে। তবে ?” “সেই লজ্জায় এসেছি। আর তো কিছুই পারি নে, পায়ের ধুলো নিয়ে মনে মনে মাপ চাই।” “কুমু যদি আজই স্বামীর ঘরে ফিরে যায় তাতে ক্ষতি আছে কি ?” “সত্যি কথা বলি, যেতে বলতে সাহস করি নে ৷” ঠিক যে কী হয়েছে বিপ্রদাস সে কথা নবীনকে জিজ্ঞাসা করলে না। মনে করলে, জিজ্ঞাসা করা অন্যায় হবে । কুমুকেও প্রশ্ন করে কোনো কথা বের করতে বিপ্ৰদাসের অভিরুচি নেই। মনের মধ্যে ছটফট করতে লাগল। কালুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি তো ওদের বাড়ি যাওয়া-আসা কর, মধুসূদনের সম্বন্ধে তুমি বোধ হয় কিছু জান ।” “কিছু আভাস পেয়েছি, কিন্তু সম্পূর্ণনা জেনে তোমার কাছে কিছু বলতে চাই নে। আর দুটাে দিন সবুর করো, খবর তোমাকে দিতে পারব।” আশঙ্কায় বিপ্ৰদাসের মন ব্যথিত হয়ে উঠল। প্ৰতিকার করবার কোনো রাস্তা তার হাতে নেই বলে দুশ্চিন্তাটা ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ক্ষণে ক্ষণে মোচড় দিতে লাগল। Ο Ο কুমু অনেকদিন যেটা একান্ত ইচ্ছা করেছিল সে ওর পূর্ণ হল ; সেই পরিচিত ঘরে, সেই ওর দাদার মেহের পরিবেষ্টনের মধ্যে এল ফিরে, কিন্তু দেখতে পেলে ওর সেই সহজ জায়গাটি নেই। এক-একবার অভিমানে ওর মনে হচ্ছে। যাই ফিরে, কেননা, ও স্পষ্ট বুঝতে পারছে সবারই মনে প্রতিদিন এই প্রশ্নটি রয়েছে, ‘ও ফিরে যাচ্ছে না কেন, কী হয়েছে ওর ?’ দাদার গভীর মেহের মধ্যে ঐ একটা উৎকণ্ঠা, সেটা নিয়ে ওদের মধ্যে স্পষ্ট আলোচনা চলে না, তার বিষয় ও নিজে, অথচ ওর কাছে সেটা চাপা রইল । বিকেল হয়ে আসছে, রোদুর পড়ে এল। শোবার ঘরের জানালার কাছে কুমু বসে। কাকগুলো ডাকাডাকি করছে, বাইরের রাস্তায় গাড়ির শব্দ আর লোকালয়ের নানা কলরব। নতুন বসন্তের হাওয়া :ಞ್ಞ! পাতিবাদামের গাছ, অস্থির হাওয়া তারই ঘনসবুজ পাতায় দোল লাগিয়ে অপরান্ধুের আলোটাকে ਅਜ যেতে চায়, যেদিন হাওয়ার মধ্যে বসন্তের ছোওয়া লাগে, মনে হয় পৃথিবী যেন উৎসুক হয়ে চেয়ে আছে নীল আকাশের দূর পথের দিকে। যা-কিছু চার দিকে বেড়ে আছে সেইটােকেই মনে হয় মিথো, : আর যার ঠিকানা পাওয়া যায় নি, যার ছবি আঁকতে গেলে রঙ যায় আকাশে ছড়িয়ে, মূর্তি উকি দিয়ে