পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

A * যোগাযোগ 8 OG তারস্বরে কলহ করেছে তখন মধুসূদন তাকে সকলের সামনেই বলেছে, “দূর হয়ে যা বজাত, বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে ” কিন্তু এতেও কিছু আসে যায় নি। শ্যামার সম্বন্ধে মধুসূদন আপন কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ বজায় রেখেছে, ইচ্ছে করে মধুসূদন নিজে তাকে যা দিয়েছে শ্যামা যখনই তার বেশি কিছুতে হাত দিতে গেছে আমনি খেয়েছে ধমক ৷ শ্যামার ইচ্ছে ছিল সংসারের কাজে মোতির মা'র জায়গাটা সেই দখল করে, কিন্তু তাতেও বাধা পেলে ; মধুসূদন মেতির মাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করে, শ্যামাসুন্দরীকে বিশ্বাস করে না । শ্যামার সম্বন্ধে ওর কল্পনায় রঙ লাগে নি, অথচ খুব মোটা রকমের "সম্পূর্ণ অভাব, বিশেষ যত্ন করবার জিনিস নয়, খাট থেকে ধুলোয় পড়ে গেলেও আসে যায় না। কিন্তু ওতে আরাম আছে । শ্যামাকে সামলিয়ে চলবার একটুও দরকার নেই ; তা ছাড়া শ্যামা সমস্ত মনপ্ৰাণের সঙ্গে ওকে যে বড়ো বলে মানে, ওর জন্যে সব সইতে সব করতে সে রাজি, এটা নিঃসংশয়ে জানার দরুন মধুসূদনের আত্মমর্যাদা সুস্থ আছে। কুমু থাকতে প্রতিদিন ওর এই আত্মমর্যাদা বড়ো বেশি নাড়া খেয়েছিল । মধুসূদনের এই আধুনিক ইতিহাসটা জািনবার জন্যে কালুকে খুব বেশি সন্ধান করতে হয় নি। ওদের বাড়িতে লোকজনের মধ্যে এই নিয়ে যথেষ্ট বলাবলি চলেছিল, অবশেষে নিতান্ত অভ্যস্ত হওয়াতে বলাবলির পালাও একরকম শেষ হয়ে এসেছে । খবরটা শোনবামাত্র বিপ্রদাসকে যেন আগুনের তীর মারলে । মধুসূদন কিছু ঢাকবার চেষ্টামাত্র করে নি, নিজের স্ত্রীকে প্রকাশ্যে অপমান করা এতই সহজ- স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার করতে বাহিরের বাধা এতই কম। স্ত্রীকে নিরুপায়ভাবে স্বামীর বাধ্য করতে সমাজে হাজার রকম যন্ত্র ও যন্ত্রণার সৃষ্টি করা হয়েছে, অথচ সেই শক্তিহীন স্ত্রীকে স্বামীর উপদ্রব থেকে বীচাবার জন্যে কোনাে আবশ্যিক পন্থা রাখা হয় নি। এরই নিদারুণ দুঃখ ও অসম্মান ঘরে ঘরে যুগে যুগে কী রকম ব্যাপ্ত হয়ে আছে এক মুহুর্তে বিপ্ৰদাস তা যেন দেখতে পেলে । সতীত্বগরিমার ঘন প্রলেপ দিয়ে এই ব্যথা মারবার চেষ্টা, কিন্তু বেদনাকে অসম্ভব করবার একটুও চেষ্টা নেই। স্ত্রীলোক এত সস্তা, এত অকিঞ্চিৎকর ! বিপ্রদাস বললে, “কুমু, অপমান সহ্য করে যাওয়া শক্ত নয়, কিন্তু সহ্য করা অন্যায় । সমস্ত স্ত্রীলোকের হয়ে তোমাকে তোমার নিজের সম্মান দাবি করতে হবে, এতে সমাজ তোমাকে যত দুঃখ দিতে পারে দিক ৷” কুমু বললে, “দাদা, তুমি কোন অপমানের কথা বলছ ঠিক বুঝতে পারছি নে ৷” বিপ্রদাস বললে, “তুই কি তবে সব কথা জানিস নে ?” কুমু বললে, “না।” বিপ্রদাস চুপ করে রইল। একটু পরে বললে, “মেয়েদের অপমানের দুঃখ আমার বুকের মধ্যে জমা হয়ে রয়েছে । কেন তা জানিস ?” কুমু কিছু না বলে দাদার মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিক পরে বললে, “চিরজীবন মা যা দুঃখ পেয়েছিলেন আমি তা কোনােমতে ভুলতে পারি নে, আমাদের ধর্মবুদ্ধিহীন সমাজ সেজন্যে দায়ী ।” এইখানে ভাইবোনের মধ্যে প্ৰভেদ আছে। কুমু তার বাবাকে খুব বেশি ভালোবাসত, জানত তার হৃদয় কত কোমল । সমস্ত অপরাধ কাটিয়েও তার বাবা ছিলেন খুব বড়ো এ কথা না মনে করে সে থাকতে পারত না, এমন-কি, তার বাবার জীবনে যে শোচনীয় পরিণাম ঘটেছিল। সেজন্যে সে তার। মাকেই মনে মনে দোষ দিয়েছে । বিপ্ৰদাসও তার বাবাকে বড়ো বলেই ভক্তি করেছে। কিন্তু বারে বারে স্থলনের দ্বারা তার মাকে তিনি সকলের কাছে অসম্মানিত করতে বাধা পান নি এটা সে কোনোমতে ক্ষমা করতে পারলে না । তার মাও ক্ষমা করেন নি বলে বিপ্ৰদাস মনের মধ্যে গৌরব বোধ করত । বিপ্রদাস বললে, “আমার মা যে অপমান পেয়েছিলেন তাতে সমস্ত স্ত্রীজাতির অসম্মান । কুমু, তুই ব্যক্তিগতভাবে নিজের কথা ভুলে সেই অসম্মানের বিরুদ্ধে দাড়াবি, কিছুতে হার মানবি নে ৷”