পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8○Wり রবীন্দ্র-রচনাবলী কুমু মুখ নিচু করে আস্তে আস্তে বললে, “বাবা কিন্তু মাকে খুব ভালোবাসতেন সে কথা ভুলো না দাদা । সেই ভালোবাসায় অনেক পাপের মার্জনা হয় ।” বিপ্রদাস বললে, “তা মানি, কিন্তু এত ভালোবাসা সত্ত্বেও তিনি এত সহজে মায়ের সম্মানহানি করতে পারতেন, সে পাপ সমাজের । সমাজকে সেজন্য ক্ষমা করতে পারব না, সমাজের ভালোবাসা নেই, আছে কেবল বিধান ।” “দাদা, তুমি কি কিছু শুনেছ ?” “হা শুনেছি, সে-সব কথা তোকে আস্তে আস্তে পরে বলব ।” “সেই ভালো । আমার ভয় হচ্ছে আজকেকার এই সব কথাবার্তায় তোমার শরীর আরো দুর্বল হয়ে যাবে ।” “না কুমু, ঠিক তার উলটাে। এতদিন দুঃখের অবসাদে শরীরটা যেন এলিয়ে পড়ছিল। আজ যখন মন বলছে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করতে হবে, আমার শরীরের ভিতর থেকে শক্তি আসছে ।” “যে সমাজ নারীকে তার মূল্য দিতে এত বেশি ফাকি দিয়েছে তার সঙ্গে লড়াই।” “তুমি তার কী করতে পার দাদা ?” ני “আমি তাকে না মানতে পারি। তা ছাড়া আরো আরো কী করতে পারি সে আমাকে ভাবতে হবে, আজ থেকেই শুরু হল কুমু। এই বাড়িতে তোর জায়গা আছে, সে সম্পূৰ্ণ তোর নিজের, আর-কারও সঙ্গে আপাস করে নয়। এইখানেই তুই নিজের জোরে থাকবি ।” “আচ্ছা দাদা, সে হবে, কিন্তু আর তুমি কথা কোয়ো না ।” এমন সময় খবর এল, মোতির মা এসেছে । Gły শোবার ঘরে কুমু মোতির মাকে নিয়ে বসল। কথা কইতে কইতে অন্ধকার হয়ে এল, বেহার এল আলো জ্বালাতে, কুমু নিষেধ করে দিলে । কুমু সব কথাই শুনলে ; চুপ করে রইল । মোতির মা বললে, “বাড়িকে ভূতে পেয়েছে বউরানী, ওখানে টিকে থাকা দায় । তুমি কি যাবে p” “আমার কি ডাক পড়েছে ?” “না, ডাকবার কথা বোধ হয় মনেও নেই। কিন্তু তুমি না গেলে তো চলবেই না ।” “আমার কী করবার আছে ? আমি তো তাকে তৃপ্ত করতে পারব না । ভেবে দেখতে গেলে আমার জন্যেই সমস্ত কিছু হয়েছে, অথচ কোনো উপায় ছিল না। আমি যা দিতে পারতুম সে তিনি নিতে পারলেন না। আজ আমি শূন্য হাতে গিয়ে কী করব ?” “বল কী বউরানী, সংসার যে তোমারই, সে তো তোমার হাতছাড়া হলে চলবে না ।” “সংসার বলতে কী বোঝ ভাই ? ঘরদুয়োর, জিনিসপত্র, লোকজন ? লজ্জা করে এ কথা বলতে যে, তাতে আমার অধিকার আছে। মহলে অধিকার খুইয়েছি, এখন কি ঐ-সব বাইরের জিনিস নিয়ে লোভ করা চলে ?” “কী বলছি ভাই বউরানী ? ঘরে কি তুমি একেবারেই ফিরবে না ?” “সব কথা ভালো করে বুঝতে পারছি নে। আর কিছুদিন আগে হলে ঠাকুরের কাছে সংকেত চাইতুম, দৈবজ্ঞের কাছে শুধোতে যৌতুম । কিন্তু আমার সে-সব ভরসা ধুয়েমুছে গেছে। আরম্ভে সব লক্ষণই তো ভালো ছিল । শেষে কোনোটাই তো একটুও খাটল না। আজ কতবার বসে বসে ভেবেছি