পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা S অমিত-চরিত অমিত রায় ব্যারিস্টার । ইংরেজি ছাদে রায় পদবী “রায়” ও “রের” রূপান্তর যখন ধারণ করলে তখন তার শ্ৰী গেল ঘুচে কিন্তু সংখ্যা হল বৃদ্ধি। এই কারণে, নামের অসামান্যতা কামনা করে অমিত এমন একটি বানান বানালে যাতে ইংরেজ বন্ধু ও বন্ধুনীদের মুখে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেল— অমিট রায়ে | অমিতার বাপ ছিলেন দিগবিজয়ী ব্যারিস্টার। যে পরিমাণ টাকা তিনি জমিয়ে গেছেন সেটা অধস্তন তিন পুরুষকে অধঃপাতে দেবার পক্ষে যথেষ্ট । কিন্তু পৈতৃক সম্পত্তির সাংঘাতিক সংঘাতেও অমিত বিনা বিপত্তিতে এ যাত্রা টিকে গেল । কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি. এ’র কোঠায় পা দেবার পূর্বেই অমিত অক্সফোর্ডে ভর্তি হয় ; সেখানে পরীক্ষা দিতে দিতে এবং না দিতে দিতে ওর সাত বছর গেল কেটে । বুদ্ধি বেশি থাকতে পড়াশুনাে বেশি করে নি, অথচ বিদ্যেতে কমতি আছে বলে ঠাহর হয় না। ওর বাপ ওর কাছ থেকে অসাধারণ কিছু প্ৰত্যাশা করেন নি। তঁর ইচ্ছে ছিল, তীর একমাত্র ছেলের মনে অক্সফোর্ডের রঙ এমন পাকা করে ধরে যাতে দেশে এসেও ধোপ সয় । অমিতকে আমি পছন্দ করি। খাসা ছেলে । আমি নবীন লেখক, সংখ্যায় আমার পাঠক স্বল্প, যোগ্যতায় তাদের সকলের সেরা অমিত । আমার লেখার ঠাট-ঠমকটা ওর চোখে খুব লেগেছে। ওর জন্তুটা যেমন, এই লোককদের রচনাও তেমনি ঘাড়ে-গর্দানে সামনে-পিছনে পিঠে-পেটে বেখাপ, চালটা ঢ়িলে নড়বড়ে, বাংলা-সাহিত্যের মতো ন্যাড়া ফ্যাকাশে মরুভূমিতেই তার চলন। সমালোচকদের কাছে সময় থাকতে বলে রাখা ভালো, মতটা আমার নয় । অমিত বলে, ফ্যাশানটা হল মুখোশ, স্টাইলটা হল মুখশ্ৰী । ওর মতে যারা সাহিত্যের ওমরাও-দলের, যারা নিজের মন রেখে চলে, স্টাইল তাদেরই। আর যারা আমলা-দলের, দশের মন রাখা যাদের ব্যাবসা, ফ্যাশন তাদেরই। বঙ্কিমি স্টাইল বঙ্কিমের লেখা “বিষবৃক্ষে", বঙ্কিম তাতে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন ; বঙ্কিমি ফ্যাশান নসিরামের লেখা “মনোমোহনের মোহনবাগানে”, নাসিরাম তাতে বঙ্কিমকে দিয়েছে মাটি করে। বারোয়ারি তাবুর কানাতের নীচে ব্যাবসাদার নাচওয়ালির দর্শন মেলে, কিন্তু শুভদৃষ্টিকালে বধুর মুখ দেখবার বেলায় বেনারসি ওড়নার ঘোমটা চাই। কানাত হল ফ্যাশানের, আর বেনারসি হল স্টাইলের, বিশেষের মুখ বিশেষ রঙের ছায়ায় দেখবার জন্যে। অমিত বলে, হাটের লোকের পায়ে-চলা রাস্তার বাইরে আমাদের পা সরাতে ভরসা পায় না বলেই আমাদের দেশে স্টাইলের এত অনাদর। দক্ষযজ্ঞের গল্পে এই কথাটির পৌরাণিক ব্যাখ্যা মেলে। ইন্দ্ৰ চন্দ্র বরুণ একেবারে স্বর্গের ফ্যাশানদুরন্ত দেবতা, যজ্ঞিকমহলে তঁদের নিমন্ত্রণও জুটিত । শিবের ছিল স্টাইল, এত ওরিজিনাল যে, মন্ত্রপাড়া যজমানেরা তাকে হব্যাকাব্য দেওয়াটা বেদস্তুর বলে জানত । অক্সফোর্ডের বি. এ’র মুখে এ-সব কথা শুনতে আমার ভালো লাগে । কেননা, আমার বিশ্বাস, আমার GIVOO