পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8මට রবীন্দ্র-রচনাবলী লেখায় স্টাইল আছে- সেইজন্যেই আমার সকল বইয়েরই এক সংস্করণেই কৈবল্যপ্ৰাপ্তি, তারা “ন পুনরাবর্তন্তে” । আমার শ্যালক নবকৃষ্ণ অমিতার এসব কথা একেবারে সইতে পারত না- বলত, “রেখে দাও তোমার অক্সফোর্ডের পাস ” সে ছিল ইংরেজি সাহিত্যে রোমহর্ষক এম. এ. ; তাকে পড়তে হয়েছে বিস্তর, বুঝতে হয়েছে অল্প। সেদিন সে আমাকে বললে, “অমিত কেবলই ছােটাে লেখককে বড়ো করে বড়ো লেখককে খাটাে করবার জন্যেই। অবজ্ঞার ঢাক পিটােবার কাজে তার শখ, তোমাকে সে করেছে তার ঢাকের কাঠি ।” দুঃখের বিষয়, এই আলোচনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন আমার স্ত্রী, স্বয়ং ওর সহোদরা । কিন্তু পরম সন্তোষের বিষয় এই যে, আমার শ্যালকের কথা তার একটুও ভালো লাগে নি । , দেখলুম, অমিতর সঙ্গেই তীর রুচির মিল, অথচ পড়াশুনাে বেশি করেন নি। স্ত্রীলোকের আশ্চর্য স্বাভাবিক বুদ্ধি ! অনেক সময় আমার মনেও খটকা লাগে যখন দেখি, কত কত নামজাদা ইংরেজ লেখকদেরকেও নগণ্য করতে অমিতার বুক দমে না । তারা হল, যাদের বলা যেতে পারে বহুবাজারে চলতি লেখক, বড়োবাজারের ছাপ-মারা ; প্রশংসা করবার জন্যে যাদের লেখা পড়ে দেখবার দরকারই হয় না, চোখ বুজে গুণগান করলেই পাসমার্ক পাওয়া যায়। অমিতার পক্ষেও এদের লেখা পড়ে দেখা অনাবশ্যক, চোখ বুজে নিন্দে করতে ওর বাধে না । আসলে, যারা নামজাদা তারা ওর কাছে বড়ো বেশি সরকারি, বর্ধমানের ওয়েটিং রুমের মতো ; আর যাদেরকে ও নিজে আবিষ্কার করেছে তাদের উপর ওর খাসদখল, যেন স্পেশাল ট্রেনের সেলুন কামরা । অমিতার নেশাই হল স্টাইলে । কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভূষায় ব্যবহারে । ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাদ আছে । পাচজনের মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম । অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে । দাড়িগোফ-কামানো চাচা মাজা চিকন শ্যামবর্ণ পরিপুষ্ট মুখ, স্মৃতিঁভরা ভাবটা, চোখ চঞ্চল, হাসি চঞ্চল, নড়াচড়া চলাফেরা চঞ্চল, কথার জবাব দিতে একটুও দেরি হয় না ; মনটা এমন এক রকমের চকমকি যে, ঠুন করে একটু ঠুকলেই স্মৃলিঙ্গ ছিটকে পড়ে। দেশী কাপড় প্রায়ই পরে, কেননা ওর দলের লোক সেটা পরে না । ধুতি সাদা থানের যত্নে কেঁচানো, কেননা ওর বয়সে এরকম ধুতি চলতি নয়। পাঞ্জাবি পরে, তার বা কঁধ থেকে বোতাম ডান দিকের কোমর অবধি, আস্তিনের সামনের দিকটা কনুই পর্যন্ত দু-ভাগ করা ; কোমরে ধুতিটাকে ঘিরে একটা জরি-দেওয়া চওড়া খয়েরি রঙের ফিতে, তারই বা দিকে ঝুলছে বৃন্দাবনী ছিটের এক ছোটাে থলি, তার মধ্যে ওর ট্যাকঘড়ি ; পায়ে সাদা চামড়ার উপর লাল চামড়ার কাজ-করা কটকি জুতো । বাইরে যখন যায় একটা পাট-করা পাড়ওয়ালা মাদ্রাজি চাদর বা কঁধ থেকে হাঁটু অবধি বুলতে থাকে ; বন্ধুমহলে যখন নিমন্ত্রণ থাকে মাথায় চড়ায় এক মুসলমানি লক্ষেী টুপি, সাদার উপর সাদা কাজ-করা । একে ঠিক সাজ বলব না, এ হচ্ছে ওর এক রকমের উচ্চ হাসি। ওর বিলিতি সাজের মর্ম আমি বুঝি নে, যারা বোঝে তারা বলে- কিছু আলুথালু গোছের বটে, কিন্তু ইংরেজিতে যাকে বলে ডিসটিংগুইশড়। নিজেকে অপরূপ করবার শখ ওর নেই, কিন্তু ফ্যাশানকে বিদ্রুপ করবার কৌতুক ওর অপৰ্যাপ্ত। কোনোমতে বয়স মিলিয়ে যারা কুষ্ঠির প্রমাণে যুবক তাদের দর্শন মেলে পথে ঘাটে ; অমিতার দুর্লভ যুবকত্ব নির্জলা যৌবনের জোরেই, একেবারে বেহিসেবি, উড়নচণ্ডী, বান ডেকে ছুটে চলেছে বাইরের দিকে, সমস্ত নিয়ে চলেছে ভাসিয়ে, হাতে কিছুই রাখে না। এ দিকে ওরা দুই বোন, যাদের ডাকনাম সিসি এবং লিসি, যেন নতুন বাজারে অত্যন্ত হালের আমদানি- ফ্যাশানের পসরায় আপাদমস্তক যত্নে মোড়ক-করা পয়লা নম্বরের প্যাকেট-বিশেষ। উচু খুরওয়ালা জুতো, লেসওয়ালা বুক-কাটা জ্যাকেটের ফঁাকে প্রবালে অ্যাম্বারে মেশানো মালা, শাড়িটা গায়ে তির্যাগভঙ্গিতে আঁট করে ল্যাপিটানো। এরা খুঁট খুঁট করে দ্রুত লয়ে চলে ; উচ্চৈঃস্বরে বলে ; স্তরে স্তরে তোলে সূক্ষ্মাগ্র হাসি ; মুখ ঈষৎ বেঁকিয়ে স্মিতহাস্যে উচু কটাক্ষে চায়, জানে কাকে বলে ভাবগর্ভ চাউনি ; গোলাপি রেশমের পাখা ক্ষণে ক্ষণে গালের কাছে ফুরফুর করে সঞ্চালন করে, এবং