পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

sve রবীন্দ্র-রচনাবলী নিজের মুখের উপর বুলিয়ে নিলে। বললে, “ভেবে দেখো বন্যা, আজ এই সকালে ঠিক এই মুহুর্তে সমস্ত পৃথিবীতে কত অসংখ্য লোকই চাচ্ছে, আর কত অল্প লোকই পেলে । আমি সেই অতি অল্প লোকের মধ্যে একজন । সমস্ত পৃথিবীতে একমাত্ৰ তুমিই সেই সৌভাগ্যবান লোককে দেখতে পেলে শিলঙ পাহাড়ের কোণে এই য়ুক্যালিপটস গাছের তলায় । পৃথিবীতে পরমাশ্চর্য ব্যাপারগুলিই পরম নম্র, চোখে পড়তে চায় না । অথচ তোমাদের ঐ তারিণী তলাপাত্র কলকাতার গোলদিঘি থেকে আরম্ভ করে নোয়াখালি-চাটগা পর্যন্ত চীৎকার-শব্দে শূন্যের দিকে ঘুষি উচিয়ে বঁকা পলিটিকসের ফাকা আওয়াজ ছড়িয়ে এল, সেই দুর্দান্ত বাজে খবরটা বাংলাদেশের সর্বপ্রধান খবর হয়ে উঠল। কে জানে, হয়তো এইটেই ভালো ।” l “কোনটা ভালো।” “ভালো এই যে, সংসারের আসল জিনিসগুলো হাটেবাটেই চলাফেরা করে বেড়ায়, অথচ বাজে লোকের চোখের ঠোকর খেয়ে খেয়ে মরে না । তার গভীর জানাজানি বিশ্বজগতের অন্তরের নাড়িতে নাড়িতে |— আচ্ছা বন্যা, আমি তো বকেই চলেছি, তুমি চুপ করে বসে কী ভাবিছ বলে তো ।” লাবণ্য চোখ নিচু করে বসে রইল, জবাব করলে না । í অমিত বললে, “তোমার এই চুপ করে থাকা যেন মাইনে না দিয়ে আমার সব কথাকে বরখাস্ত করে (f.33K AANVS II” লাবণ্য চোখ নিচু করেই বললে, “তোমার কথা শুনে আমার ভয় হয় মিতা ।” “ভয় কিসের ।” “তুমি আমার কাছে কী যে চাও আর আমি তোমাকে কতটুকুই-বা দিতে পারি ভেবে পাই নে ৷” “কিছু না ভেবেই তুমি দিতে পার। এইটােতেই তো তোমার দানের দাম ।” “তুমি যখন বললে কর্তা-মা সম্মতি দিয়েছেন, আমার মনটা কেমন করে উঠল। মনে হল, এইবার আমার ধরা পড়বার দিন আসছে।” “ধরাই তো পড়তে হবে ।” “মিতা, তোমার রুচি তোমার বুদ্ধি আমার অনেক উপরে । তোমার সঙ্গে একত্রে পথ চলতে গিয়ে একদিন তোমার থেকে বহুদূরে পিছিয়ে পড়ব, তখন আর তুমি আমাকে ফিরে ডাকবে না। সেদিন আমি তোমাকে একটুও দোষ দেব না— না না, কিছু বোলো না, আমার কথাটা আগে শোনো । মিনতি করে বলছি, আমাকে বিয়ে করতে চেয়ে না । বিয়ে করে তখন গ্ৰন্থি খুলতে গেলে তাতে আরো জট পড়ে যাবে । তোমার কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি সে আমার পক্ষে যথেষ্ট, জীবনের শেষ পর্যন্ত চলবে । তুমি কিন্তু নিজেকে ভুলিয়ে না।” r “বন্যা, তুমি আজকের দিনের ঔদার্যের মধ্যে কালকের দিনের কাপণ্যের আশঙ্কা কেন তুলছ ।” “মিতা, তুমিই আমাকে সত্য বলবার জোর দিয়েছ। আজ তোমাকে যা বলছি তুমি নিজেও তা ভিতরে ভিতরে জান । মানতে চাও না, পাছে যে রস এখন ভোগ করছ, তাতে একটুও খটকা বাধে । তুমি তো সংসার ফাদবার মানুষ নও, তুমি রুচির তৃষ্ণা মেটাবার জন্য ফেরো ; সাহিত্যে সাহিত্যে তাই তোমার বিহার, আমার কাছেও সেইজন্যেই তুমি এসেছ। বলব ঠিক কথাটা ? বিয়েটাকে তুমি মনে মনে জান, যাকে তুমি সর্বদাই বল, ভালগার। ওটা বড়ো রেসপেকটেবল ; ওটা শাস্ত্রেীর-দোহাই-পাড়া সেই সব বিষয়ী লোকের পোষা জিনিস যারা সম্পত্তির সঙ্গে সহধর্মিণীকে মিলিয়ে নিয়ে খুব মোটা তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে।” “বন্যা, তুমি আশ্চর্য নরম সুরে আশ্চর্য কঠিন কথা বলতে পাের।” “মিতা, ভালোবাসার জোরে চিরদিন যেন কঠিন থাকতেই পারি, তোমাকে ভোলাতে গিয়ে একটুও ফাকি যেন না দিই। তুমি যা আছ। ঠিক তাই থাকো, তোমার রুচিতে আমাকে যতটুকু ভালো লাগে ততটুকুই লাগুক, কিন্তু একটুও তুমি দায়িত্ব নিয়ে না, তাতেই আমি খুশি থাকব ।” “বন্যা, এবার তবে আমার কথাটা বলতে দাও । কী আশ্চর্য করেই তুমি আমার চরিত্রের ব্যাখ্যা