পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8O রবীন্দ্র-রচনাবলী স্ত্রীপুরুষ যে বড়ো বেশি কাছাকাছি এসে পড়ে— মাঝে ফাক থাকে না, তখন একেবারে গোটা মানুষকে নিয়েই কারবার করতে হয় নিতান্ত নিকটে থেকে । কোনো-একটা অংশ ঢাকা রাখবার জো থাকে না ।” “লাবণ্য, তুমি নিজেকে জান না । তোমাকে নিতে গেলে কিছুই বাদ দিয়ে নেবার দরকার হবে না।” “কিন্তু, উনি তাে আমাকে চান না। যে আমি সাধারণ মানুষ, ঘরের মেয়ে, তাকে উনি দেখতে পেয়েছেন বলে মনেই করি নে। আমি যেই ওঁর মনকে স্পর্শ করেছি আমনি ওঁর মন অবিরাম ও অজস্র কথা কয়ে উঠেছে। সেই কথা দিয়ে উনি কেবলই আমাকে গড়ে তুলেছেন । ওঁর মন যদি ক্লান্ত হয়, কথা যদি ফুরোয় তবে সেই নিঃশব্দের ভিতরে ধরা পড়বে এই নিতান্ত সাধারণ মেয়ে, যে মেয়ে ওঁর নিজের সৃষ্টি নয় । বিয়ে করলে মানুষকে মেনে নিতে হয়, তখন আর গড়ে নেবার ফাক পাওয়া যায় " “তোমার মনে হয় অমিত তোমার মতো মেয়েকেও সম্পূৰ্ণ মেনে নিতে পারবে না ?” “স্বভাব যদি বদলায়। তবে পারবেন । কিন্তু বদলাবেই বা কেন । আমি তো তা চাই না ।” "डूनि की 5ा७ ।” “যতদিন পারি, নাহয় ওঁর কথার সঙ্গে, ওঁর মনের খেলার সঙ্গে মিশিয়ে স্বপ্ন হয়েই থাকব । আর স্বপ্নই বা তাকে বলব কেন । সে আমার একটা বিশেষ জন্ম, একটা বিশেষ রূপ, একটা বিশেষ জগতে সে সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে। নাহয় সে গুটি-থেকে-বোর-হয়ে-আসা দু-চারদিনের একটা রঙিন প্রজাপতিই হল, তাতে দোষ কী- জগতে প্ৰজাপতি আর-কিছুর চেয়ে যে কম সত্য তা তো নয়-- নাহয় সে সূর্যোদয়ের আলোতে দেখা দিলে আর সূর্যাস্তের আলোতে মরেই গেল, তাতেই বা কী । কেবল এইটুকুই দেখা চাই যে সেটুকু সময় যেন ব্যর্থ হয়ে না যায় ।” “সে যেন বুঝলুম, তুমি অমিতর কাছে নাহয় ক্ষণকালের মায়া-রূপেই থাকবে । আর নিজে ? তুমিও কি বিয়ে করতে চাও না । তোমার কাছে অমিতও কি মায়া ।” লাবণ্য চুপ করে বসে রইল, কোনো জবাব করলে না | যোগমায়া বললেন, “তুমি যখন তর্ক কর তখন বুঝতে পারি, তুমি অনেক-বই-পড়া মেয়ে ; তোমার মতো করে ভাবতেও পারি নে, কথা কইতেও পারি। নে ; শুধু তাই নয়, হয়তো কাজের বেলাতেও এত শক্ত হতে পারি। নে । কিন্তু তর্কের ফাকের মধ্যে দিয়েও যে তোমাকে দেখেছি, মা । সেদিন রাত তখন বারোটা হবে- দেখলুম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরে গিয়ে দেখি তোমার টেবিলের উপর নুয়ে পড়ে দুই হাতের মধ্যে মুখ রেখে তুমি কঁাদিছ। এ তো ফিলজফি-পড়া মেয়ে নয়। একবার ভাবলুম সাস্তুনা দিয়ে আসি ; তার পরে ভাবলুম, সব মেয়েকেই কাদবার দিনে কেঁদে নিতে হবে, চাপা দিতে যাওয়া কিছু নয়। এ কথা খুবই জানি, তুমি সৃষ্টি করতে চাও না, ভালোবাসতে চাও । মনপ্রাণ দিয়ে সেবা না করতে পারলে তুমি বঁাচবে কী করে। তাই তো বলি, ওকে কাছে না পেলে তোমার চলবে না । বিয়ে করব না বলে হঠাৎ পণ করে বোসো না । একবার তোমার মনে একটা জেদ চাপলে আর তোমাকে সোজা করা যায় না, তাই ভয় করি ।” লাবণ্য কিছু বললে না, নতমুখে কোলের উপর শাড়ির আঁচলটা চেপে চেপে অনাবশ্যক ভাজ করতে লাগল। যোগমায়া বললেন, “তোমাকে দেখে আমার অনেকবার মনে হয়েছে, অনেক পড়ে অনেক ভেবে তোমাদের মন বেশি সূক্ষ্ম হয়ে গেছে ; তোমরা ভিতরে ভিতরে যে-সব ভােব গড়ে তুলছ আমাদের সংসারটা তার উপযুক্ত নয়। আমাদের সময়ে মনের যে-সব আলো অদৃশ্য ছিল, তোমরা আজ যেন সেগুলোকেও ছাড়ান দিতে চাও না । তারা দেহের মোটা আবরণটাকে ভেদ করে দেহটাকে যেন অগোচর করে দিচ্ছে। আমাদের আমলে মনের মোটা মোটা ভাবগুলো নিয়ে সংসারে সুখদুঃখ যথেষ্ট ছিল, সমস্যা কিছু কম ছিল না। আজ তোমরা এতই বাড়িয়ে তুলছ, কিছুই আর সহজ রাখলে कीं ।” লাবণ্য একটুখানি হাসলে। এই সেদিন অমিত অদৃশ্য আলোর কথা যোগমায়াকে বোঝাচ্ছিল, তার থেকে এই যুক্তি তার মাথায় এসেছে- এও তো সূক্ষ্ম। যোগমায়ার মা-ঠাকরুন। এ কথা এমন করে