পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8)SR রবীন্দ্র-রচনাবলী যেখানে সর্বদাই প্রয়োজন সেখানে আসবার সময় সেটা আনবার কথা মনে হয় নি। একটা ছাতা সঙ্গে ছিল, সেটা খুব সম্ভব কোনো-একদিন সংকল্পিত গম্যস্থানেই ফেলে এসেছে, আর তা যদি না হয় তবে সেই বুড়ো দেওদারের তলে সেটা আছে পড়ে। যোগমায়া ঘরে ঢুকে বললেন, “এ কী কাণ্ড অমিত।” অমিত তাড়াতাড়ি টেবিলের নীচে থেকে বেরিয়ে এসে বললে, “আমার ঘরটা আজ অসম্বদ্ধ প্ৰলাপে মেতেছে, দশা আমার চেয়ে ভালো নয় ।” “অসম্বন্ধ প্ৰলাপ ?” “অর্থাৎ, বাড়ির চালটা প্ৰায় ভারতবর্ষ বললেই হয় । অংশগুলোর মধ্যে সম্বন্ধটা আলগা । এইজন্যে উপর থেকে উৎপাত ঘটলেই চারিদিকে এলোমেলো অশ্রুবর্ষণ হতে থাকে, আর বাইরের দিক থেকে যদি ঝড়ের দাপট লাগে। তবে সো সো করে উঠতে থাকে দীর্ঘশ্বাস । আমি তো প্রোটেস্ট স্বরূপে মাথার উপরে এক মঞ্চ খাড়া করেছি— ঘরের মিসগভর্নমেন্টের মাঝখানেই নিরুপদ্রব হােমরুলের দৃষ্টান্ত। পলিটিকসের একটা মূলনীতি এখানে প্রত্যক্ষ ।” “মূলনীতিটা কী শুনি।” “সেটা হচ্ছে এই যে, যে ঘরওয়ালা ঘরে বাস করে না সে যতবড়ো ক্ষমতাশালীই হােক, তার শাসনের চেয়ে যে দরিদ্র বাসাড়ে ঘরে থাকে তার যেমন-তেমন ব্যবস্থাও ভালো ।” আজ লাবণ্যর পরে যোগমায়ার খুব রাগ হল। অমিতকে তিনি যতই গভীর করে স্নেহ করছেন ততই মনে মনে তার মূর্তিটা খুব উচু করেই গড়ে তুলছেন। ‘এত বিদ্যে, এত বুদ্ধি, এত পাস, অথচ এমন সাদা মন । গুছিয়ে কথা বলবার কী অসামান্য শক্তি !! আর, যদি চেহারার কথা বল, আমার চোখে তো লাবণ্যর চেয়ে ওকে অনেক বেশি সুন্দর ঠেকে । লাবণ্যর কপাল ভালো, অমিত কোন গ্রহের চক্রান্তে ওকে এমন মুগ্ধ চোখে দেখেছে। সেই সোনার চাদ ছেলেকে লাবণ্য এত করে দুঃখ দিচ্ছে। খামক বলে বসলেন। কিনা, বিয়ে করবেন না। যেন কোন রাজরাজেশ্বরী। ধনুক-ভাঙা পণ । এত অহংকার সইবে কেন। পােড়ারমুখকে যে কেঁদে কেঁদে মরতে হবে।” একবার যোগমায়া ভাবলেন অমিতকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যাবেন তাদের বাড়িতে। তার পরে কী ভেবে বললেন, “একটু বোসো বাবা, আমি এখনই আসছি।” বাড়ি গিয়েই চােখে পড়ল, লাবণ্য তার ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে পায়ের উপর শাল মেলে গোর্কির 'মা' বলে গল্পের বই পড়ছে। ওর এই আরামটা দেখে ওঁর মনে মনে রাগ আরো বেড়ে উঠল। বললেন, “চলো, একটু বেড়িয়ে আসবে।” সে বললে, “কর্তা-মা, আজ বেরোতে ইচ্ছে করছে না।” । যোগমায়া ঠিক বুঝলেন না যে, লাবণ্য নিজের কাছ থেকে ছুটে গিয়ে এই গল্পের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। সমস্ত দুপুরবেলা, খাওয়ার পর থেকেই, তার মনের মধ্যে একটা অস্থির অপেক্ষা ছিল, কখন আসবে অমিত । কেবলই মন বলেছে, এল বুঝি। ঘাইরে দমকা হাওয়ার দীেরাত্ম্যে পাইন গাছগুলো থেকে থেকে ছট্‌ফটু করে, আর দুর্দান্ত বৃষ্টিতে সদ্যোজাত ঝরনাগুলো এমনি ব্যতিব্যস্ত, যেন তাদের মেয়াদের সময়টার সঙ্গে উর্ধবশ্বাসে তাদের পাল্লা চলেছে। লাবণ্যর মধ্যে একটা ইচ্ছে আজ অশান্ত হয়ে উঠল- যাক সব বাধা ভেঙে, সব দ্বিধা উড়ে, অমিতার দুই হাত আজ চেপে ধরে বলে উঠি, জন্মে-জন্মান্তরে আমি তোমার। আজ বলা সহজ। আজ সমস্ত আকাশ যে মরিয়া হয়ে উঠল, হুহু করে কী-যে হেঁকে উঠছে তার ঠিক নেই, তারই ভাষায় আজ বন-বনান্তর ভাষা পেয়েছে, বৃষ্টিধারায় আবিষ্ট গিরিশৃঙ্গগুলো আকাশে কান পেতে দাড়িয়ে রইল। আমনি করেই কেউ শুনতে আসুক লাবণ্যর কথা- অমনি মস্ত করে, স্তব্ধ হয়ে, অমনি উদার মনোযোগে । কিন্তু প্ৰহরের পর প্রহর যায়, কেউ আসে না । ঠিক মনের কথাটি বলার লগ্ন যে উত্তীর্ণ হয়ে গেল ! এর পরে যখন কেউ আসবে তখন কথা জুটবে না, তখন সংশয় আসবে মনে, তখন তাণ্ডবনৃত্যেন্মত্ত দেবতার মাভৈঃ-রব আকাশে মিলিয়ে যাবে । বৎসরের পর বৎসর নীরবে চলে যায়, তার মধ্যে বাণী একদিন বিশেষ প্রহরে হঠাৎ মানুষের দ্বারে এসে আঘাত করে। সেই সময়ে দ্বার খোলবার চাবিটি যদি না পাওয়া গেল। তবে