পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Qのやり রবীন্দ্র-রচনাবলী ᎩᏔᏱ আশঙ্কা সকালবেলায় কাজে মন দেওয়া আজ লাবণ্যর পক্ষে কঠিন । সে বেড়াতেও যায় নি। অমিত বলেছিল, শিলঙ থেকে যাবার আগে আজ সকালবেলায় সে ওদের সঙ্গে দেখা করতে চায় না, সেই পণটাকে রক্ষা করবার ভার দুজনেরই উপর। কেননা, যে রাস্তায় ও বেড়াতে যায় সেই রাস্তা দিয়েই অমিতকে যেতে হবে । মনে তাই লোভ ছিল যথেষ্ট । সেটাকে কষে দমন করতে হল। যোগমায়া খুব সকালেই স্নান সেরে তীর আহ্নিকের জন্যে কিছু ফুল তোলেন। তিনি বেরোবার আগেই লাবণ্য সে জায়গাটা থেকে চলে এল য়ুক্যালিপটাস-তলায়। হাতে দুই-একটা বই ছিল, বোধ হয় নিজেকে এবং অন্যদেরকে ভোলাবার জন্যে । তার পাতা খোলা ; কিন্তু বেলা যায়, পাতা ওলটানো হয় না । মনের মধ্যে কেবলই বলছে, জীবনের মহােৎসবের দিন কাল শেষ হয়ে গেল। আজ সকালে এক-একবার মেঘরৌদ্রের মধ্যে দিয়ে ভাঙনের দূত আকাশ বেঁটিয়ে বেড়াচ্ছে। মনে দৃঢ় বিশ্বাস যে, অমিত চিরপলাতক, একবার সে সরে গেলে আর তার ঠিকানা পাওয়া যায় না। রাস্তায় চলতে চলতে কখন সে গল্প শুরু করে, তার পর রাত্রি আসে, পরদিন সকালে দেখা যায়, গল্পের গাথন ছিন্ন, পথিক গেছে। চলে । লাবণ্য তাই ভাবছিল, ওর গল্পটা এখন থেকে চিরদিনের মতো রইল বাকি । আজ সেই অসমাপ্তির স্নানতা সকালের আলোয়, অকাল-অবসানের অবসাদ আদ্র হওয়ার মধ্যে । এমন সময়, বেলা তখন নােটা, অমিত দুমদাম-শব্দে ঘরে ঢুকেই “মাসিমা” “মাসিমা” করে ডাক দিলে। যোগমায়া প্ৰাতঃসন্ধ্যা সেরে ভাড়ারের কাজে প্রবৃত্ত। আজ তারও মনটা পীড়িত । অমিত তার কথায় হাসিতে চাঞ্চল্যে এতদিন তার মেহাসক্ত মনকে, তার ঘরকে ভরে রেখেছিল । সে চলে গেছে এই ব্যথার বোঝা নিয়ে তার সকালবেলাটা যেন বৃষ্টিবিন্দুর ভারে সদ্যঃপাতী ফুলের মতো নুয়ে পড়ছে। র্তার বিচ্ছেদকাতর ঘরকন্নার কাজে আজ তিনি লাবণ্যকে ডাকেননি ; বুঝেছিলেন, আজ তার দরকার ছিল একলা থাকার, লোকের চোখের আড়ালে । লাবণ্য তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল, কোলের থেকে বই গেল পড়ে, জানতেও পারলে না । এ দিকে যোগমায়া ভাড়ারঘর থেকে দ্রুতপদে বেরিয়ে এসে বললেন, “কী বাবা অমিত, ভূমিকম্প নাকি ৷” “ভূমিকম্পই তো। জিনিসপত্র রওনা করে দিয়েছি ; গাড়ি ঠিক ; ডাকঘরে গেলুম দেখতে চিঠিপত্র কিছু আছে কি না । সেখানে এক টেলিগ্রাম।” অমিতার মুখের ভাব দেখে যোগমায়া উদবিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “খবর সব ভালো তো ?” লাবণ্যও ঘরে এসে জুটল। অমিত ব্যাকুল মুখে বললে, “আজই সন্ধেবেলায় আসছে সিসি, আমার বোন, তার বন্ধু কেটি মিত্তির, আর তার দাদা নরেন।” “তা ভাবনা কিসের বাছা । শুনেছি, ঘোড়দৌড়ের মাঠের কাছে একটা বাড়ি খালি আছে। যদি নিতান্ত না পাওয়া যায় আমার এখানে কি একরকম করে জায়গা হবে না।” “সেজন্যে ভাবনা নেই মাসি। তারা নিজেরাই টেলিগ্ৰাফ করে হােটেলে জায়গা ঠিক করেছে।” “আর যাই হােক বাবা, তোমার বোনেরা এসে যে দেখবে তুমি ঐ লক্ষ্মীছাড়া বাড়িটাতে আছ সে কিছুতেই হবে না। তারা আপন লোকের খোপামির জন্যে দায়িক করবে। আমাদেরই।” “না মাসি, আমার প্যারাডাইস লস্ট। ঐ নগ্ন আসবাবের স্বৰ্গ থেকে আমার বিদায়। সেই দড়ির খাটিয়ার নীড় থেকে আমার সুখস্বপ্নগুলো উড়ে পালাবে। আমাকেও জায়গা নিতে হবে সেই অতিপরিচ্ছন্ন হােটেলের এক অতিসভ্য কামরায় ।” কথাটা বিশেষ কিছু নয়, তবু লাবণ্যর মুখ বিবৰ্ণ হয়ে গেল। এতদিন একটা কথা ওর মনেও আসে নি যে, অমিতার যে সমাজ সে ওদের সমাজ থেকে সহস্ৰ যোজন দূরে। এক মুহুর্তেই সেটা বুঝতে পারলে। অমিত যে আজ কলকাতায় চলে যাচ্ছিল তার মধ্যে বিচ্ছেদের কঠোর মূর্তি ছিল না। কিন্তু এই যে আজ ও হােটেলে যেতে বাধ্য হল এইটােতেই লাবণ্য বুঝলে, যে-বাসা এতদিন ওরা দুজনে