পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা Ø Oዓ নানা অদৃশ্য উপকরণে গড়ে তুলছিল সেটা কোনোদিন বুঝি আর দৃশ্য হবে না । - লাবণ্যর দিকে একটু চেয়ে অমিত যোগমায়াকে বললে, “আমি হােটেলেই যাই আর জাহান্নামেই যাই, কিন্তু এইখানেই রইল আমার আসল বাসা ।” অমিত বুঝেছে, শহর থেকে আসছে একটা অশুভ দৃষ্টি । মনে মনে নানা প্ল্যান করছে যাতে সিসির দল এখানে না। আসতে পারে । কিন্তু ইদানীং ওর চিঠিপত্র আসছিল যোগমায়ার বাড়ির ঠিকানায়, তখন ভাবে নি কোনো সময়ে তাতে বিপদ ঘটতে পারে । অমিতার মনের ভাবগুলো চাপা থাকতে চায় না, এমন-কি, প্রকাশ পায় কিছু আতিশয্যের সঙ্গে। ওর বোনের আসা সম্বন্ধে অমিতার এত বেশি উদবেগ যোগমায়ার কাছে অসংগত ঠেকেছিল । লাবণ্যও ভাবলে, অমিত ওকে নিয়ে বোনেদের কাছে লজিত । ব্যাপারটা লাবণ্যর কাছে বিস্বাদ ও অসম্মানজনক হয়ে দাঁড়াল । অমিত লাবণ্যকে জিজ্ঞাসা করলে, “তোমার কি সময় আছে। বেড়াতে যাবে ?” লাবণ্য একটু যেন কঠিন করে বললে, “না, সময় নেই।” যোগমায়া ব্যস্ত হয়ে বললেন, “যাও-না মা, বেড়িয়ে এসো গে।” । লাবণ্য বললে, “কর্তা-মা, কিছুকাল থেকে সুরমাকে পড়ানোয় বড়ো অবহেলা হয়েছে। খুবই অন্যায় করেছি। কাল রাত্রেই ঠিক করেছিলুম, আজ থেকে কিছুতেই আর টিলেমি করা হবে না।” বলে। লাবণ্য ঠোঁট চেপে মুখ শক্ত করে রইল । লাবণ্যর এই জেদের মেজাজটা যোগমায়ার পরিচিত । পীড়াপীড়ি করতে সাহস করলেন না । অমিতও নীরস কণ্ঠে বললে, “আমিও চললুম কর্তব্য করতে, ওদের জন্যে সব ঠিক করে রাখা চাই ।” এই বলে যাবার আগে বারান্দায় একবার স্তব্ধ হয়ে দাড়ােল । বললে, “বন্যা, ঐ চেয়ে দেখো । গাছের আড়াল থেকে আমার বাড়ির চালটা অল্প একটু দেখা যাচ্ছে। একটা কথা তোমাদের বলা হয় নি, ঐ বাড়িটা কিনে নিয়েছি । বাড়ির মালেক অবাক । নিশ্চয় ভেবেছে, ওখানে সোনার গোপন খনি আবিষ্কার করে থাকব । দাম বেশ-একটু চড়িয়ে নিয়েছে। ওখানে সোনার খনির সন্ধান তো পেয়েইছিলুম, সে সন্ধান একমাত্র আমিই জানি । আমার জীর্ণ কুটিরের ঐশ্বৰ্য সবার চোখ থেকে লুকানো থাকবে ।” লাবণ্যর মুখে গভীর একটা বিষাদের ছায়া পড়ল। বললে, “আর-কারও কথা অত করে তুমি ভাব কেন । নাহয় আর-সবাই জানতে পারলে । ঠিকমত জানতে পারাই তো চাই, তা হলে কেউ অমর্যাদা করতে সাহস করে না ।” এ কথার কেনো উত্তর না দিয়ে অমিত বললে, “বন্যা, ঠিক করে রেখেছি বিয়ের পরে ঐ বাড়িতেই আমরা কিছুদিন এসে থাকব ; আমার সেই গঙ্গার ধারের বাগান, সেই ঘাট, সেই বটগাছ, সব মিলিয়ে গেছে ঐ বাড়িটার মধ্যে । তোমার দেওয়া মিতালি নাম ওকেই সাজে ।” “ও বাড়ি থেকে আজ তুমি বেরিয়ে এসেছ মিতা। আবার একদিন যদি ঢুকতে চাও দেখবে, ওখানে তোমাকে কুলোবে না। পৃথিবীতে আজকের দিনের বাসায় কালকের দিনের জায়গা হয় না। সেদিন তুমি বলেছিলে, জীবনে মানুষের প্রথম সাধনা দারিদ্র্যের, দ্বিতীয় সাধনা ঐশ্বর্যের । তার পরে শেষ সাধনার কথা বল নি ; সেটা হচ্ছে ত্যাগের ।” “বন্যা, ওটা তোমাদের রবি ঠাকুরের কথা । সে লিখেছে, শাজাহান আজ তার তাজমহলকেও ছাড়িয়ে গেল । একটা কথা তোমার কবির মাথায় আসে নি যে, আমরা তৈরি করি তৈরি-জিনিসকে ছাড়িয়ে যাবার জন্যেই। বিশ্বসৃষ্টিতে ঐটেকেই বলে এভোলুশন। একটা অনাসৃষ্টি-ভুত ঘাড়ে চেপে থাকে, বলে, সৃষ্টি করে ; সৃষ্টি করলেই ভূত নামে, তখন সৃষ্টিটাকেও আর দরকার থাকে না। কিন্তু তাই বলে ঐ ছেড়ে-যাওয়াটাই চরম কথা নয় । জগতে শাজাহান-মমতাজের অক্ষয় ধারা বয়ে চলেছেই। ওরা কি একজন মাত্র। সেইজন্যেই তো তাজমহল কোনোদিন শূন্য হতেই পারল না। নিবারণ চক্রবর্তী বাসরঘরের উপর একটা কবিতা লিখেছে- সেটা তোমাদের কবিবরের তাজমহলের সংক্ষিপ্ত ||MOMO