পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শেষের কবিতা Ο Σ. Φ. হাতে তাকে গতিয়ে দেবার কৌশল করছে। পুরুষমানুষকে ঠকাতে অধিক বুদ্ধির দরকার করে না, বিধাতার স্বহস্তে তৈরি ঠুলি, তাদের দুই চোখে পরানো । সিসি সামনে এসে যোগমায়াকে নমস্কারের একটু আভাস দিয়ে বললে, “আমি সিসি, আমির বোন ।” যোগমায়া একটু হেসে বললেন, “আমি আমাকে মাসি বলে, সেই সম্পর্কে আমি তোমারও মাসি হই কেটির রকম দেখে যোগমায়া তাকে লক্ষ্যই করলেন না । সিসিকে বললেন, “এসো মা, ঘরে বসবে এসো ।” সিসি বললে, “সময় নেই, কেবল খবর নিতে এসেছি, আমি এসেছে কি না ।” যোগমায়া বললেন, “এখনো আসে নি ।” “কখন আসবেন জানেন ?” “ঠিক বলতে পারি নে- আচ্ছা, আমি জিজ্ঞাসা করে আসি গে।” কেটি তার স্বস্থানে বসেই তীব্ৰস্বরে বলে উঠল, “যে মাস্টারনী এখানে বসে পড়াচ্ছিল সে তো ভান করলে অমিটকে সে কোনোকালে জানেই না ।” যোগমায়ার ধাধা লেগে গেল। বুঝলেন, কোথাও একটা গোল আছে। এও বুঝলেন, এদের কাছে মান রাখা শক্ত হবে। এক মুহুর্তে মাসিত্ব পরিহার করে বললেন, “শুনেছি। অমিতবাবু আপনাদের হোটেলেই থাকেন, তার খবর আপনাদেরই জানা আছে।” কেটি বেশ একটু স্পষ্ট করেই হাসলে। তাকে ভাষায় বললে বোঝায়, ‘লুকোতে পাের, ফাকি দিতে পারবে না ।” আসল কথা, গোড়াতেই লাবণ্যকে দেখে এবং অমিকে সে চেনে না। শুনে কেটি মনে মনে আগুন হয়ে আছে। কিন্তু সিসির মনে আশঙ্কা আছে মাত্র, জ্বালা নেই ; যোগমায়ার সুন্দর মুখের গান্তীর্য তার মনকে টেনেছিল । তাই যখন দেখলে কেটি তাকে স্পষ্ট অবজ্ঞা দেখিয়ে চৌকি ছাড়লে না, তার মনে কেমন সংকোচ লাগল। অথচ কোনো বিষয়ে কেটির বিরুদ্ধে যেতে সাহস হয় না, কেননা, কেটি সিডিশন দমন করতে ক্ষিপ্ৰহস্ত- একটু সে বিরোধ সয় না। কর্কশ ব্যবহারে তার কোনো সংকোচ নেই। অধিকাংশ মানুষই ভীরু, অকুষ্ঠিত দুর্ব্যবহারের কাছে তার হার মানে । নিজের অজস্র কঠোরতায় কেটির একটা গৰ্ব আছে। যাকে সে মিষ্টিমুখে ভালোমানুষ বলে, বন্ধুদের মধ্যে তার কোনো লক্ষণ দেখলে তাকে সে অস্থির করে তোলে । রাঢ়তাকে সে অকপটতা বলে বড়াই করে, এই রূঢ়তার আঘাতে যারা সংকুচিত তারা কোনোমতে কোিটকে প্রসন্ন রাখতে পারলে আরাম পায়। সিসি সেই দলের । সে কোটিকে মনে মনে যতই ভয় করে ততই তার নকল করে, দেখাতে যায়, সে দুর্বল নয়। সব সময়ে পেরে ওঠে না। কোিট আজ বুঝেছিল, তার ব্যবহারের বিরুদ্ধে সিসির মনের কোণে একটা মুখ-চােরা আপত্তি লুকিয়েছিল। তাই সে ঠিক করেছিল, যোগমায়ার সামনে সিসির এই সংকোচ কড়া করে ভাঙতে হবে । চৌকি থেকে উঠল, একটা সিগারেট নিয়ে সিসির মুখে বসিয়ে দিলে, নিজের ধরানো সিগারেট মুখে করেই সিসির সিগারেট ধরাবার জন্যে মুখ এগিয়ে নিয়ে এল । প্রত্যাখান করতে সিসি সাহস করলে না। কানের ডগাটা একটুখানি লাল হয়ে উঠল। তবু জোর করে এমনি একটা ভাব দেখালে, যেন তাদের হাল পাশ্চত্যিকতায় যাদের ভু এতটুকু কুঞ্চিত হবে তাদের মুখের উপর ও তুড়ি মারতে প্ৰস্তুত- that much for it! ঠিক সেই সময়টাতে অমিত এসে উপস্থিত । মেয়েরা তো অবাক । হােটেল থেকে যখন সে বেরিয়ে এল, মাথায় ছিল ফেল্ট হ্যাট, গায়ে ছিল বিলিতি কোর্তা। এখানে দেখা যাচ্ছে পরনে তার ধুতি আর শাল। এই বেশাস্তিরের আড্ডা ছিল তার সেই কুটিরে। সেইখানে আছে একটি বইয়ের শেলফ, ' একটি কাপড়ের তোরঙ্গ আর যোগমায়ার দেওয়া একটি আরামকেদারা । হােটেল থেকে মধ্যাহ্নভোজন সেরে এইখানে সে আশ্রয় নেয়। আজকাল লাবণ্যর শাসন কড়া, সুরমাকে পড়ানোর