পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য ○8○ এই বর্ণনাগুলি কতবার পাঠ করিয়াছি তাহার সংখ্যা নাই, এবং এই সকল শ্লোকের মধ্য দিয়া রচনাতেও প্রকৃতিবর্ণনা আছে কিন্তু তাহা প্রথাসংগত বৰ্ণনামাত্র, তাহা কেবল কবির কর্তব্যপালন । তাহার মধ্যে সেই সোনার কাঠি নাই যাহার স্পর্শে নিখিল প্রকৃতির অন্তরাত্মা সজীব ও সজাগ হইয়া আমাদিগকে নিবিড় প্ৰেমপাশে আবদ্ধ করে । সাময়িক কবিদিগের সহিত বিহারীলালের আর-একটি প্রধান প্ৰভেদ তাহার ভাষা । ভাষার প্রতি আমাদের অনেক কবির কিয়ৎপরিমাণে অবহেলা আছে। বিশেষত মিত্ৰাক্ষর ছন্দের মিলাটা তাহারা নিতান্ত কায়ক্লেশে রক্ষা করেন । অনেকে কেবলমাত্র শেষ অক্ষরের মিলকে যথেষ্ট জ্ঞান করেন এবং অনেকে “হয়েছে 'করেছে। ভুলেছে। প্রভৃতি ক্রিয়াপদের মিলকে মিল বলিয়া গণ্য করিয়া থাকেন। মিলের দুইটি প্রধান গুণ আছে, এক তাহা কৰ্ণতৃপ্তিকর আর-এক অভাবিতপূর্ব। অসম্পূর্ণ মিলে কর্ণেব তৃপ্তি হয় না, সেটুকু মিলে স্বরের অনৈক্যটা আরো যেন বেশি করিয়া ধরা পড়ে এবং তাঁহাতে কবির ক্ষমতা ও ভাষার দারিদ্র্য প্ৰকাশ পায় । ক্রিয়াপদের মিল যত ইচ্ছা করা যাইতে পারে- সেরূপ মিলে কৰ্ণে প্ৰত্যেকবার নূতন বিস্ময় উৎপাদন করে না, এইজন্য তাহা বিরক্তিজনক ও "একঘেয়ে হইয়া ওঠে । বিহারীলালের ছন্দে মিলের এবং ভাষার দৈন্য নাই । তাহা প্রবহমান নিবারের মতো সহজ সংগীতে অবিশ্রাম ধ্বনিত হইয়া চলিয়াছে। ভাষা স্থানে স্থানে সাধুতা পরিত্যাগ করিয়া অকস্মাৎ অশিষ্ট এবং কৰ্ণপীড়ক হইয়াছে, ছন্দ অকারণে আপনি বাধ ভাঙিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া উঠিয়াছে, কিন্তু সে কবির স্বেচ্ছাকৃত ; অক্ষমতাজনিত নহে। তঁহার রচনা পড়িতে পড়িতে কোথাও এ কথা মনে হয় না যে, এইখানে কবিকে দায়ে পড়িয়া মিল নষ্ট বা ছন্দ ভঙ্গ করিতে হইয়াছে। কিন্তু উপরে যে ছন্দের শ্লোকগুলি উদধূত হইয়াছে “বঙ্গসুন্দরীতে সেই ছন্দই প্রধান নহে। প্রথম উপহারটি ব্যতীত “বঙ্গসুন্দরীর অন্য-সকল কবিতার ছন্দই পৰ্যায়ক্রমে বারো এবং এগারো অক্ষরে ভাগ করা । যথা আনত সুষমা কুসুম ভরে, চাচর চিকুর নীরদ মালিকা লুটায়ে পড়েছে ধরণী-"পারে।” এ ছন্দ নারীবর্ণনার উপযুক্ত বটে— ইহাতে তালে তালে নুপুর ঝংকৃত হইয়া উঠে। কিন্তু এ ছন্দের প্রধান অসুবিধা এই যে, ইহাতে যুক্ত অক্ষরের স্থান নাই। পয়ার ত্রিপদী প্রভৃতি ছন্দে লেখকের এবং পাঠকের অনেকটা স্বাধীনতা আছে । অক্ষরের মাত্রাগুলিকে কিয়ৎপরিমাণে ইচ্ছামত বাড়াইবার কমাইবার অবকাশ আছে। প্রত্যেক অক্ষরকে একমাত্রার স্বরূপ গণ্য করিয়া একেবারে এক নিশ্বাসে পড়িয়া যাইবার আবশ্যক হয় না। দৃষ্টান্তের দ্বারা আমার কথা স্পষ্ট হইবে।-- “হে সারাদে দাও দেখা । বাচিতে পারি। নে একা, কাতর হয়েছে প্ৰাণ, কাতর হৃদয় । কী বলেছি অভিমানে ९७८ || ७ || ८, বেদনা দিয়ে না প্ৰাণে ব্যথার সময় ।” ইহার মধ্যে প্রায় যুক্ত অক্ষর নাই। নিম্নলিখিত শ্লোকে অনেকগুলি যুক্তাক্ষর আছে, অথচ উভয় শ্লোকই সুখপাঠ্য এবং শ্রুতিমধুর। 帖 ‘পদে পৃথ্বী, শিরে ব্যোম, তুচ্ছ তারা সূর্য সোম, নক্ষত্ৰ নখগ্ৰে যেন গনিবারে পারে,