পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(88 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সম্মুখে সাগর।াম্বারা ছড়িয়ে রয়েছে ধরা, কটাক্ষে কখন যেন দেখিছে তাহারে ।” এই দুটি শ্লোকই কবির রচিত “সারদামঙ্গল হইতে উদধূত। এক্ষণে “বঙ্গসুন্দরী হইতে দুইটি শ্লোক উদধূত করিয়া তুলনা করা যাক । “একদিন দেব তরুণ তপন অপরূপ এক কুমারী রতন খেলা করে নীল নলিনীদলে ।” ইহার সহিত নিম্ন-উদধূত শ্লোকটি একসঙ্গে পাঠ করিলে প্ৰভেদ প্রতীয়মান হইবে। − ‘অন্সরী কিন্নরী দাড়াইয়ে তীরে বাজায়ে বাজায়ে বীণা ধীরে ধীরে গাঁহিছে আদরে স্নেহের গান ৷” ‘অন্সরী কিন্নৱী’ যুক্ত অক্ষর লইয়া এখানে ছন্দ ভঙ্গ করিয়াছে। কবিও এই কারণে “বঙ্গসুন্দরীতে যথাসাধ্য যুক্ত অক্ষর বর্জন করিয়া চলিয়াছেন । কিন্তু বাংলা যে-ছন্দে যুক্ত অক্ষরের স্থান হয় না সে-ছন্দ আদরণীয় নহে। কারণ, ছন্দের ঝংকার এবং ধ্বনিবৈচিত্ৰ্য, যুক্ত অক্ষরের উপরেই অধিক নির্ভর করে। একে বাংলা ছন্দে স্বরের দীর্ঘহস্বতা নাই, তার উপরে যদি যুক্ত অক্ষর বাদ পড়ে তবে ছন্দ নিতান্তই অস্থিবিহীন সুললিত শব্দপিণ্ড হইয়া পড়ে। তাহা শীঘ্রই শ্রান্তিজনক তন্দ্ৰাকর্ষক হইয়া উঠে, এবং হৃদয়কে আঘাতপূর্বক ক্ষুব্ধ করিয়া তুলিতে পারে না। সংস্কৃত ছন্দে যে বিচিত্র সংগীত তরঙ্গিত হইতে থাকে তাহার প্রধান কারণ স্বরের দীর্ঘহস্বতা এবং যুক্ত অক্ষরের বাহুল্য। মাইকেল মধুসূদন ছন্দের এই নিগুঢ় তত্ত্বটি অবগত ছিলেন সেইজন্য র্তাহার অমিত্ৰাক্ষরে এমন পরিপূর্ণ ধ্বনি এবং তরঙ্গিত গতি অনুভব করা যায়। আৰ্যদর্শনে বিহারীলালের “সারদামঙ্গল’ সংগীত যখন প্রথম বাহির হইল, তখন ছন্দের প্রভেদ মুহুর্তেই প্রতীয়মান হইল। "সারদামঙ্গলে’র ছন্দ নূতন নহে, তাহা প্রচলিত ত্রিপদী, কিন্তু কবি তাহা সংগীতে সৌন্দর্যে সিঞ্চিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। ‘বঙ্গসুন্দরী’র ছন্দোলালিত্য অনুকরণ করা সহজ, এবং সেই মিষ্টতা একবার অভ্যস্ত হইয়া গেলে তাহার বন্ধন ছেদন করা কঠিন। কিন্তু "সারদামঙ্গলের গীতসৌন্দর্য অনুকরণসাধ্য নহে। “সারদামঙ্গল’ এক অপরূপ কাব্য । প্রথম যখন তাহার পরিচয় পাইলাম তখন তাহার ভাষায় ভাবে এবং সংগীতে নিরতিশয় মুগ্ধ হইতাম, অথচ তাহার আদ্যোপােন্ত একটা সুসংলগ্ন অর্থকরিতে পারিতাম না। যেই একটু মনে হয় এইবার বুঝি কাব্যের মর্ম পাইলাম অমনি তাহা আকার পরিবর্তন করে । সূর্যস্তকালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার মতো সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয়, কিন্তু কোনো রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না- অথচ সুদূর সৌন্দর্যস্বৰ্গ হইতে একটি অপূর্ব পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে। এইজন্য সারদামঙ্গলের শ্রেষ্ঠতা অরসিক লোকের নিকট ভালোরূপে প্ৰমাণ করা বড়োই কঠিন হইত। যে বলিত ‘আমি বুঝিলাম না - আমাকে বুঝাইয়া দাও, তাহার নিকট হার মানিতে হইত। কবি যাহা দিতেছেন তাঁহাই গ্ৰহণ করিবার জন্য পাঠককে প্রস্তুত হওয়া উচিত ; পাঠক যাহা চান তাহাই কাব্য হইতে আদায় করিবার চেষ্টা করিতে গেলে অধিকাংশ সময়ে নিরাশ হইতে হয়। তাহার ফল হয়, যাহা চাই তাহ পাই না এবং কবি যাহা দিতেছেন তাহা হইতেও বঞ্চিত হইতে হয় । "সারদামঙ্গলে কৰি যাহা গাহিতেছেন তাহা কান পাতিয়া শুনিলে একটি স্বগীয় সংগীতসুধায় হৃদয় অভিষিক্ত হইয়া উঠে, কিন্তু সমালোচনা-শান্ত্রের আইনের মধ্য হইতে তাহাকে ছাকিয়া লইবার চেষ্টা