পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ᏩᎶ:Ꮤ2 r রবীন্দ্র-রচনাবলী ‘নিত্য অপরাঢ়ে আমি লাতেহার পাহাড়ের ক্রোড়ে গিয়া বসিতাম, তাঁবুতে শত কার্য থাকিলেও আমি তাহা ফেলিয়া যাইতাম । চারিটা বাজিলে আমি অস্থির হইতাম ; কেন তাহা কখনো ভাবিতম না ; পাহাড়ে কিছুই নূতন নাই ; কাহারও সহিত সাক্ষাৎ হইবে না, কোনো গল্প হইবে না, তথাপি কেন আমায় সেখানে যাইতে হইত জানি না । এখন দেখি এ বেগ আমার একার নহে। যে সময় উঠানে ছায়া পড়ে, নিত্য সে সময় কুলবধুর মন মাতিয়া উঠে জল আনিতে যাইবে । জল আছে বলিলেও তাহারা জল ফেলিয়া জল আনিতে যাইবে । জলে যে যাইতে পাইল না সে অভাগিনী, সে গৃহে বসিয়া দেখে উঠানে ছায়া পড়িতেছে, আকাশে ছায়া পড়িতেছে, পৃথিবীর রঙ ফিরিতেছে, বাহির হইয়া সে তাহা দেখিতে পাইল না, তাহার কত দুঃখ । বোধ হয় আমিও পৃথিবীর রঙ-ফেরা দেখিতে যাইতাম।” চন্দ্ৰনাথবাবু বলেন"জল আছে বলিলেও তাহারা জল ফেলিয়া জল আনিতে যায়, আমাদের মেয়েদের জল আনা এমন আমাদের বিবেচনায় সমালোচকের এ প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক । হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করিয়া দেখিয়া থাকিবে, হয়তো নাও দেখিতে পারে। কুলবধুরা জল ফেলিয়াও জল আনিতে যায়, সাধারণের স্থূলদুষ্টির অগোচর এই নবাবিষ্কৃত তথ্যটির জন্য আমরা উপরি-উদ্দধূত বৰ্ণনাটির প্রশংসা করি না। বাংলাদেশে অপরাহুে মেয়েদের জল আনিতে যাওয়া। --নামক সর্বসাধারণের সুগোচর একটি অত্যন্ত পুরাতন ব্যাপারকে সঞ্জীব নিজের কল্পনার সৌন্দৰ্যকিরণ দ্বারা মণ্ডিত করিয়া তুলিয়াছেন বলিয়া উক্ত বর্ণনা আমাদের নিকট আদরের সামগ্ৰী। যাহা সুগোচর তাহা সুন্দর হইয়া উঠিয়াছে ইহা আমাদের পরম লাভ । সম্ভবত, সত্যের হিসাব হইতে দেখিতে গেলে অনেক মেয়ে ঘাটে সখীমণ্ডলীর নিকট গল্প শুনিতে বা কুৎসা রটনা করিতে যায়, হয়তো সমস্ত দিন গৃহকার্যের পর ঘরের বাহিরে জল আনিতে যাওয়াতে তাহারা একটা পরিবর্তন অনুভব করিয়া সুখ পায়, অনেকেই হয়তো নিতান্তই কেবল একটা অভ্যাসপালন করিবার জন্য ব্যগ্র হয় মাত্র, কিন্তু সেই সকল মনস্তত্ত্বের মীমাংসাকে আমরা এ স্থলে অকিঞ্চিৎকর জ্ঞান করি । অপরাহুে জল আনিতে যাইবার যতগুলি কারণ সম্ভব হইতে পারে। তন্মধ্যে সব চেয়ে যেটি সুন্দর সঞ্জীব সেইটি আরোপ করিবামাত্র অপরাহের ছায়ালোকের সহিত মিশ্রিত হইয়া কুলবধুর জল আনার দৃশ্যটি বড়োই মনোহর হইয়া উঠে ; এবং যে মেয়েটি জল আনিতে যাইতে পারিল না বলিয়া একা বসিয়া শূন্যমনে দেখিতে থাকে উঠানের ছায়া দীর্ঘতর এবং আকাশের ছায়া নিবিড়ােতর হইয়া আসিতেছে, তাহার বিষন্ন মুখের উপর সায়াহ্নের স্নান স্বর্ণচ্ছায়া পতিত হইয়া গৃহপ্ৰাঙ্গণতলে একটি অপরূপ সুন্দর মূর্তির সৃষ্টি করিয়া তোলে। এই মেয়েটিকে যে সঞ্জীব লক্ষ্য করিয়াছেন এবং আমরা লক্ষ্য করি নাই তাহা নহে, তিনি ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি ইহাকে সম্ভবপররূপে স্থায়ী করিয়া তুলিয়াছেন। আমরা জিজ্ঞাসা করিতেও চাহি না, এইরূপ মেয়ের অস্তিত্ব বাংলাদেশে সাধারণত সত্য কি না এবং সেই সত্যটি সঞ্জীবের দ্বারা আবিষ্কৃত হইয়াছে কি না। আমরা কেবল অনুভব করি ছবিটি সুন্দর বটে এবং অসম্ভবও নহে। সঞ্জাববাবু এক স্থলে লিখিয়াছেন— । ‘বাল্যকালে আমার মনে হইত যে, ভূত প্ৰেত যে প্রকার নিজে দেহহীন, অন্যের দেহ-আবির্ভাবে বিকাশ পায়, রূপও সেইপ্রকার অন্য দেহ অবলম্বন করিয়া প্রকাশ পায় ; কিন্তু প্ৰভেদ এই যে, ভূতের আশ্রয় কেবল মুনাষ্য, বিশেষত মানবী, কিন্তু বৃক্ষপল্লব নদ ও নদী প্রভৃতি সকলেই রূপ আশ্রয় করে।” সুতরাং রূপ এক, তবে পাত্ৰভেদ ।” সঞ্জাববাবুর এই মতটি অবলম্বন করিয়া চন্দ্রনাথবাবু বলিয়াছেন“সঞ্জীববাবুর সৌন্দর্যতত্ত্ব ভালো করিয়া না বুঝিলে তাহার লেখাও ভালো করিয়া বুঝা যায় না, ভালো করিয়া সম্ভোগ করা যায় না ।” সমালোচকের এ কথায় আমরা কিছুতেই সায় দিতে পারি না। কোনো-একটি বিশেষ সৌন্দর্যতত্ত্ব অবলম্বন না করিলে সঞ্জীবের রচনার সৌন্দর্য বুঝা যায় না। এ কথা যদি সত্য হইত। তবে তাহার রচনা।