পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য ܬܬܘ কৃষ্ণচরিত্র যেরূপ কৃষ্ণবর্ণে চিত্রিত ছিল তাঁহাতে প্রথমত সেই পূর্বসংস্কার ঘুচাইবার জন্য তঁহাকে বিপুল প্ৰয়াস পাইতে হইয়াছে। যেখানে তাহার দেবপ্রতিমা প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে সেখানকার জঙ্গল সাফ করিবার জন্য তঁহাকে কুঠার ধারণ করিতে হইয়াছিল। কৃষ্ণ সম্বন্ধে আমাদের সংস্কার এবং বিশ্বাসযোগ্য প্রকৃত কৃষ্ণ যে অনেক বিভিন্ন, বঙ্কিমের ‘কৃষ্ণচরিত্র হইতে তাহা আমরা শিক্ষা করিয়াছি। : কিন্তু বঙ্কিম এই গ্রন্থে অনাবশ্যক যে-সকল কলহের অবতারণা করিয়াছেন আমাদের নিকট তাহা অত্যন্ত পীড়াজনক বোধ হইয়াছে। কারণ, যে আদর্শ হৃদয়ে স্থির রাখিয়া বঙ্কিম এই গ্ৰন্থখানি রচনা করিয়াছেন, সেই আদর্শের দ্বারাই সমস্ত ভাষা এবং ভাব অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিলে তবেই সে আদর্শের মর্যাদা রক্ষা হয়। বঙ্কিম যদি তুচ্ছ বিরোধ এবং অনুদার সমালোচনার অবতারণাপূর্বক চাঞ্চল্য প্রকাশ করেন তবে সেই চাঞ্চল্য র্তাহার আদর্শের নিত্য নির্বিকারতা দূর করিয়া ফেলে। অনেক ঝগড়া আছে যাহা সাপ্তাহিক পত্রের বাদপ্রতিবাদেই শোভা পায়, যাহা কোনো চিরস্মরণীয় চিরস্থায়ী গ্রন্থে স্থান পাইবার একেবারে অযোগ্য । 腺 ‘পাশ্চাত্য মুখ অর্থাৎ য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণের প্রতি লেখক অজস্র অবজ্ঞা বর্ষণ করিয়াছেন । প্রথমত সে-কাজটাই গৰ্হিত ; দ্বিতীয়ত এমন গ্রন্থে সেটা অত্যন্ত অশোভন হইয়াছে। মান্যজনের সমক্ষে অন্য কাহারও প্রতি অযথা দুর্ব্যবহার কেবল দুর্ব্যবহার মাত্র নহে, তাহা মান্য ব্যক্তির প্রতিও অশিষ্টতা । বঙ্কিম র্যাহাকে মানবিশ্রেষ্ঠ বলিয়া জ্ঞান করেন, যিনি একাধারে ক্ষমা ও শৌর্যের আধার, যিনি সক্ষম হইয়াও অকারণে, এমন-কি, সকারণে অস্ত্র ধারণা করিতে অনেক সময়েই বিরত হইয়াছেন, তাহারই চরিত্র-প্রতিষ্ঠা-স্থলে তঁহারই আদর্শের সম্মুখে উপবিষ্ট হইয়া মতভেদ-উপলক্ষে চপলতা প্রকাশ করা । আদর্শের অবমাননা । কেবল য়ুরোপীয় পণ্ডিতগণের প্রতি নহে, সাধারণত য়ুরোপীয় জাতির প্রতিই লেখক স্থানে অস্থানে তীব্ৰ বৈরিতা প্রকাশ করিয়াছেন । দুই-একটা দৃষ্টান্ত উদধূত করি । শিশুপালের গালি ‘শুনিয়া ক্ষমাগুণের পরমাধার পরামযোগী আদর্শপুরুষ কোনো উত্তর করিলেন না। কৃষ্ণের এমন শক্তি ছিল যে তদণ্ডেই তিনি শিশুপালকে বিনষ্ট করিতে সক্ষম— পরবর্তী ঘটনায় পাঠক তাহা জানিবেন । কৃষ্ণও কখনো যে এরূপ পরুিষবাচনে তিরস্কৃত হইয়াছিলেন এমন দেখা যায় না। তথাপি তিনি এ তিরস্কারে ভুক্ষেপও করিলেন না। যুরোপীয়দের মতো ডাকিয়া বলিলেন না, “শিশুপাল, ক্ষমা বড়ো ধর্ম, আমি তোমায় ক্ষমা করিলাম।” নীরবে শক্ৰকে ক্ষমা করিলেন ।” শ্ৰীকৃষ্ণের ক্ষমাগুণের বর্ণনাস্থলে অকারণে যুরোপীয়দের প্রতি একটা অন্যায় খোচা দেওয়া যে কেবল অনাবশ্যক হইয়াছে তাহা নহে ; ইহাতে মূল উদ্দেশ্যটি পর্যন্ত নষ্ট হইয়াছে। পাঠকদের চিত্তকে যেরূপভাবে প্রস্তুত করিয়া তুলিলে তাহারা কৃষ্ণের ক্ষমাশক্তির মহাত্ম্য হৃদয়ে গ্ৰহণ করিতে পারিত তাহা ভাঙিয়া দেওয়া হইয়াছে। ‘কৃষ্ণচরিত্রের ন্যায় গ্ৰন্থ কেবল আধুনিক হিন্দুদের জন্য লিখিত হওয়া উচিত নহে, তাহা সৰ্বকালের সর্বজাতির জন্যই রচিত হওয়া কর্তব্য। পাঠকেরা অনায়াসেই বুঝিতে পরিবেন। এই অংশ পাঠ্যকালে একজন য়ুরোপীয় পাঠকের মনে কিরূপ বিদ্রোহী ভাবের উদয় হওয়া সম্ভব । বিশেষত, ক্ষমা করিবার সময় ক্ষমাধর্মের মহিমাকীর্তন যে য়ুরোপীয়দের জাতীয় প্রকৃতি এরূপ সাধারণ কথা লেখক কোথা হইতে সংগ্ৰহ করিলেন বলা কঠিন। আমাদের শাস্ত্রে এরূপ উদাহরণ ভুরি ভুরি আছে- যখন বিশ্বামিত্ৰ বশিষ্ঠের গভী বলপূর্বক হরণ করিয়া লইয়া যাইতেছিলেন এবং নন্দিনী অতিশয় তাড়িত হইয়া আর্তরবে বশিষ্ঠের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন তখন বশিষ্ঠ কহিলেন, “হে ভদ্রে । নন্দিনী, তুমি পুনঃপুনঃ রব করিতেছ, তাহা আমি শুনিতেছি ; কিন্তু হে ভদ্রে, যখন রাজা বিশ্বামিত্র তোমাকে বলপূর্বক হরণ করিতেছেন তখন আমি কী করিব ! যেহেতু আমি ক্ষমাশীল ব্ৰাহ্মণ।” পুনশ্চ - নন্দিনী তাহার নিকট কাতরতা প্ৰকাশ করিলে তিনি কহিলেন, ‘ক্ষত্রিয়ের বল তেজ এবং ব্ৰাহ্মণের বল ক্ষমা ; অতএব আমি ক্ষমাগুণে আকৃষ্ট হইতেছি ।” ইন্দ্ৰিয়সুখাভিলাষী ব্যক্তিগণ মধ্যবস্থাতেই সন্তুষ্ট থাকে; কিন্তু উহা দুঃখের আকর ; রাত্মলাভ বা বনবাস সুখের নিদান।” শ্ৰীকৃষ্ণের এই মহাদুক্তি উদধূত করিয়া বঙ্কিম বলিতেছেন