পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য ¢ዒ S করিতে হইত না । য়ুরোপে আজি কালি সভ্যতার উজ্জ্বলালোকে এই কারণে অনেক পত্নীহত্যা, পতিহত্যা হইতেছে। আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের বিশ্বাস যাহাই বিলাতি তাহাঁই চমৎকার, পবিত্র, দোষশূন্য, উর্ধধঃ চতুর্দশ পুরুষের উদ্ধারের কারণ। আমার বিশ্বাস, আমরা যেমন বিলাতের কাছে অনেক শিখিতে পারি, বিলাতও আমাদের কাছে অনেক শিখিতে পারে। তাহার মধ্যে এই বিবাহতত্ত্ব একটা কথা ।” কৃষ্ণ যখন একাধিক বিবাহ করেন নাই তখন বিবাহসম্বন্ধীয় এই তর্ক নিতান্তই অনাবশ্যক ; তাহা ছাড়া তর্কটারই বা কী মীমাংসা হইল। প্রথম স্থির হইল, যাহার স্ত্রী রুগণ অথবা ভ্ৰষ্টা অথবা বন্ধ্যা সে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে পারে। কিন্তু য়ুরোপে রুগণা, ভ্ৰষ্টা এবং বন্ধ্যার স্বামী সহজে দারান্তর পরিগ্রহ করিতে পারে না বলিয়াই যে সেখানকার সভ্যতার উজ্বলালোকে এত পত্নীহত্যা হইতেছে তাহা নহে ; অনেক সময় পত্নীর প্রতি বিরাগ ও অন্যের প্রতি অনুরাগ্যবশত হত্যা ঘটনা অধিকতর সম্ভবপর। যদি সে হত্যা নিবারণ করিতে হয় তবে অন্য স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ সঞ্চারকেও দ্বিতীয় স্ত্রী-গ্ৰহণের ধর্মসংগত বিধান বলিয়া স্থির করিতে হয়। তাহা হইলে সচরাচর অকারণে পুরুষের একাধিক বিবাহ অধৰ্ম এ কথাটার এই তাৎপর্য দাড়ায় যে, যখন দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করিতে যাইবে তখন যেন একটা কোনো কারণ থাকে, কাজটা যেন অকারণে না হয়। অর্থাৎ যদি তোমার স্ত্রী রুগণ অক্ষম হয় তবে তুমি বিবাহ করিতে পাের, অথবা যদি অন্য স্ত্রী বিবাহ করিতে তোমার ইচ্ছা বোধ হয় তাহা হইলেও তুমি বিবাহ করিতে পাের ; কারণ, সেইরূপ ইচ্ছার বাধা পাইয়া ইংলন্ডের অষ্টম হেনরি পত্নীহত্যা করিয়াছিলেন । , কিন্তু কোনো কারণ না থাকিলে বিবাহ করিয়ো না । জিজ্ঞাস্য এই যে, স্বামীকে যে যুক্তি অনুসারে যে-সকল স্বাধীন ক্ষমতার অধিকারী করা হইল, ঠিক সেই যুক্তি অনুসারে অনুরূপ স্থলে স্ত্রীর প্রতি অনুরূপ ক্ষমতা অর্পণ করা যায় কি না, এবং আমাদের সমাজে স্ত্রীর সেই সকল স্বাধীন ক্ষমতা না থাকতে অনেক স্ত্রী “অতি ঘোর নারকী পাতৃকে পতিত হয় কি না । ইহার অনতিপরেই সুভদ্ৰাহরণ কাৰ্যটা যে বিশেষ দোষের হয় নাই। ইহাই প্ৰতিপন্ন করিতে গিয়া লেখক, ‘মালাবরী’ নামক এক পারসি— সম্ভবত র্যাহার খ্যাতিপুষ্প বর্তমান কালের গুটিকয়েক সংবাদপত্রপুটের মধ্যেই কীটের দ্বারা জীৰ্ণ হইতে থাকিবে- তাহার প্রতি একটা খোচা দিয়া আর-একটা সামাজিক তর্ক তুলিয়াছেন। সে তর্কটারও মীমাংসা কিছুমাত্র সন্তোষজনক হয় নাই, অথচ লেখক অধীরভাবে অসহিষ্ণু ভাষায় অনেকের সঙ্গে অনর্থক একটা কলহ করিয়াছেন। বঙ্কিম যদি কৃষ্ণকে দেবতা না মনে করিতেন এবং কৃষ্ণের সমস্ত চিত্তবৃত্তির সর্বাঙ্গীণ উৎকর্ষ সম্বন্ধে র্তাহার কোনোরূপ থিয়োরি না থাকিত তাহা হইলে এ-সমস্ত তর্ক-বিতর্কের কোনো প্রয়োজন থাকিত না, এবং তিনি সর্বত্র সংযম রক্ষা করিয়া চলিতে পারিতেন । তাহা হইলে তিনি নিরপেক্ষ নির্বিকীরচিত্তে মহাভারতকার কবির আদর্শ কৃষ্ণকে অবিকলভাবে উদ্ধার করিয়া পাঠকদের সম্মুখে উপনীত । করিতেন- এবং পাছে কোনো অবিশ্বাসী সংশয়ী পাঠক তাহার কৃষ্ণচরিত্রের কোনো অংশে তিলমাত্র অসম্পূর্ণতা দেখিতে পায় এজন্য আগেভাগে তাঁহাদের প্রতি রোষ প্রকাশ করিয়া তাহার গ্রন্থ হইতে উচ্চসাহিত্যের লক্ষণগত আচঞ্চল শান্তি দূর করিয়া দিতেন না। যেমন প্ৰকাশ্য রঙ্গমঞ্চের উপরে নেপথ্যবিধান করিতে আরম্ভ করিলে অভিনয়ের রসভঙ্গ হয়, কাব্যসৌন্দর্য সমগ্রভাবে শ্রোতৃবর্গের মনের মধ্যে মুদ্রিত হয় না, সেইরূপ বঙ্কিমের কৃষ্ণচরিত্রের পদে পদে তর্কযুক্তিবিচার উপস্থিত হইয়া আসল কৃষ্ণচরিত্রটিকে পাঠকের হৃদয়ে অখণ্ডভাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে বাধা দিয়াছে। কিন্তু বঙ্কিম বলিতে পারেন, “কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থটি স্টেজ নহে ; উহা নেপথ্য ; স্টেজ-ম্যানেজার। আমি নানা বাধাবিয়ের সহিত সংগ্ৰাম করিয়া, নানা স্থান হইতে নানা সাজসজা আনয়নপূর্বক কৃষ্ণকে নরোত্তমবেশে সাজাইয়া দিলাম— এখন কোনো কবি আসিয়া যবনিকা উত্তোলন করিয়া দিন, অভিনয় আরম্ভ করুন, সর্বসাধারণের মনোহরণ করিতে থাকুন। তঁহাকে শ্রমসাধ্য চিন্তাসাধ্য বিচারসাধ্য কাজ কিছুই করিতে হইবে না। :