পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য Φ ή\O ভারাক্রান্ত, কাৰ্যক্ষেত্রে সর্বদাই দ্বিধাপরায়ণ মনের বোঝাটা বহিয়া বেড়াইতে হয়- কিন্তু ‘রাজসিংহ-জগতে অধিকাংশ লোকের যেন আপনার ভার নাই । যাহারা আজকালকার ইংরাজি নভেল বেশি পড়ে তাহদের কাছে এই লঘুতা বড়ো বিস্ময়জনক । আধুনিক ইংরাজি নভেলে পদে পদে বিশ্লেষণ- একটা সামান্যতম কার্যের সহিত তাহার দূরতম কারণ পরম্পরা গাথিয়া দিয়া সেটাকে বৃহদাকার করিয়া তোলা হয়- ব্যাপারটা হয়তো ছোটো কিন্তু তাহার নথিটা বড়ো বিপর্যয় । আজকালকার নভেলিস্টরা কিছুই বাদ দিতে চান না, তাহদের কাছে সকলই গুরুতর। এইজন্য উপন্যাসে সংসারের ওজন ভয়ংকর বাড়িয়া উঠিয়াছে। ইংরাজের কথা জানি না, কিন্তু আমাদের মতো পাঠককে তাহাতে অত্যন্ত ক্লিষ্ট করে । এইজন্য আধুনিক উপন্যাস আরম্ভ করিতে ভয় হয় । মনে হয়, কর্মক্লান্ত মানবহৃদয়ের পক্ষে বাস্তবজগতের চিন্তাভার অনেক সময় যথেষ্ট্রের বেশি হইয়া পড়ে, আবার যদি সাহিত্যও নির্দয় হয় তবে আর পলায়নের পথ থাকে না । সাহিত্যে আমরা জগতের সত্য চাই, কিন্তু জগতের ভার চাহি না । কিন্তু সত্যকে সম্যক প্রতীয়মান করিয়া তুলিবার জন্য কিয়ৎপরিমাণে ভারের আবশ্যক, সেটুকু ভারে কেবল সত্য ভালোরাপ অনুভবগম্য হইয়া হৃদয়ের আনন্দ উৎপাদন করে ; কল্পনাজগৎ প্রত্যক্ষবৎ দৃঢ় স্পর্শযোগ্য ও চিরস্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত বোধ হয়। বঙ্কিমবাবু রাজসিংহে সেই আবশ্যক ভারেরও কিয়দংশ যেন বাদ দিয়াছেন বোধ হয়। ভারে যেটুকু কম পড়িয়াছে গতির দ্বারায় তাহা পূরণ করিয়াছেন। উপন্যাসের প্রত্যেক অংশ অসন্দিগ্ধরূপে সম্ভবপর ও প্রশ্নসহকরিয়া তুলেন নাই, কিন্তু সমস্তটার উপর দিয়া এমন দ্রুত অবলীলাভঙ্গিতে চলিয়া গিয়াছেন যে প্রশ্ন করিবার আবশ্যক হয় নাই । যেন রেলপথের মাঝে মাঝে এমন এক-আধটা ব্রিজ আছে যাহা পুরা মজবুত বলিয়া বোধ হয় না- কিন্তু চালক তাহার উপর দিয়া এমন দ্রুত গাড়ি লইয়া চলে যে, ব্রিজ ভাঙিয়া পড়িবার অবসর পায় না । এমন হইবার কারণও স্পষ্ট পড়িয়া রহিয়াছে। যখন বৃহৎ সৈন্যদল যুদ্ধ করিতে চলে তখন তাহারা সমস্ত ঘরকারনা কাধে করিয়া লইয়া চলিতে পারে না। বিস্তর আবশ্যক দ্রব্যের মায়াও তাহাদিগকে ত্যাগ করিতে হয় । চলৎশক্তির বাধা তাহাদের পক্ষে মারাত্মক । গৃহস্থ-মানুষের পক্ষে উপকরণের প্রাচুর্য এবং ভারবাহুল্য শোভা পায় । রাজসিংহের গল্পটা সৈন্যদলের চলার মতো- ঘটনাগুলা বিচিত্র বাহ রচনা করিয়া বৃহৎ আকারে চলিয়াছে। এই সৈন্যদলের নায়ক র্যাহারা তাহারাও সমান বেগে চলিয়াছেন, নিজের সুখদুঃখের খাতিরে কোথাও বেশিক্ষণ থামিতে পারিতেছেন না । একটা দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। রাজসিংহের সহিত চঞ্চলকুমারীর প্রণয়ব্যাপারটা তেমন ঘনাইয়া উঠে নাই বলিয়া কোনাে কোনাে পাঠক এবং সম্ভবত বহুসংখ্যক পাঠিক আক্ষেপ করিয়া থাকেন। বঙ্কিমবাবু বড়ো-একটি দুর্লভ অবসর পাইয়াছিলেন- এই সুযোগে কন্দপের পঞ্চশরে এবং করুণরসের বরুণবাণে দিগবিদিক সমকুল করিয়া তুলিতে পারিতেন। কিন্তু তাহার সময় ছিল না । ইতিহাসের সমস্ত প্রবাহ তখন একটি সংকীর্ণ সন্ধিপথে বিজন্তনিতরবে ফেনাইয়া চলিতেছে- তাহারই উপর দিয়া সামাল সামাল তরী। তখন রহিয়া-বসিয়া ইনিয়া-বিনিয়া প্রেমাভিনয় করিবার সময় নহে । তখনকার যে প্ৰেম, সে অত্যন্ত বাহুল্যবর্জিত সংক্ষিপ্ত সংহত । সে তো বাসররাত্রের সুখশয্যার বাসন্তী প্রেম নহে- ঘনবর্ষার কালরাত্রে মৃত্যু হঠাৎ পশ্চাৎ হইতে আসিয়া দোলা দিয়াছেমান-অভিমান লাজ-কেলজ বিসর্জন দিয়া ত্ৰস্ত নায়িকা চকিত বাহুপাশে নায়ককে বাধিয়া ফেলিয়াছে। এখন সুদীর্ঘ সুমধুর ভূমিকার সময় নাই। এই অকস্মাৎ মৃত্যুর দোলায় সকলেই সজাগ হইয়া উঠিয়াছে এবং আপনার অন্তরবাসী মহাপ্রাণীর আলিঙ্গন অনুভব করিতেছে। কোথায় ছিল ক্ষুদ্র রূপনগরের অন্তঃপুরপ্রান্তে একটি বালিকা, কালক্রমে সে কোন ক্ষুদ্র রাজপুত নৃপতির শত রাস্ত্রীর মধ্যে অন্যতম হইয়া অসম্ভব-চিত্রিত লতার উপরে