পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য (brS তাহাতে রচনা সত্যবৎ হয় না, তাহার পরিমাণ-সামঞ্জস্য নষ্ট হইয়া যায় এবং বাহিরের নির্লিপ্ত পাঠকদের নিকটে কিরূপে বিষয়টিকে সমগ্র এবং সপ্রমাণ করিতে হইবে তাহার ঠাহর থাকে না । কিন্তু এই দ্বিতীয় নম্বর গল্পটিতেও লেখক যেখানেই নবযুগের আবর্ত ছাড়িয়া খাটি মানুষগুলির কথা বলিয়াছেন সেইখানেই দুই-চারিটি সরল বর্ণনায় স্বল্প রেখাপাতে অতি সহজেই চিত্র আঁকিয়াছেন এবং পাঠকের হৃদয়কে রসে অভিষিক্ত করিয়াছেন । এক স্থলে গ্রন্থকার প্রসঙ্গক্রমে শ্ৰীধর ঘোষের সহিত কেবল চকিতের মতো আমাদের পরিচয় করাইয়া তাহাকে অপসৃত করিয়া দিয়াছেন- কিন্তু সেই স্বল্পকালের পরিচয়েই আমাদের মনে একটা আক্ষেপ রাখিয়া গিয়াছেন ; আমাদের বিশ্বাস, লেখক মনোযোগ করিলে এই শ্ৰীধর ঘোষটিকে একটি গ্রন্থের কেন্দ্ৰস্থলে স্থাপন করিয়া আর-একটি উপন্যাসকে প্ৰাণদান করিতে পারিতেন। আমরা শ্ৰীধরের সংক্ষেপ পরিচয়টি এ স্থলে উদধূত করি। “এই ঘোষা-পরিবার বৈষ্ণব পরিবার- গোসায়ের শিষ্য । শ্ৰীধর ঘোষ মহাশয় অতি সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক ছিলেন । উদরান্নের জন্য স্নেচ্ছের অধীনে কাজ করিতেন বটে, কিন্তু নিষ্ঠার কিছুমাত্র ব্যাঘাত হইত না। আপিসে যখন কর্ম করিতেন, তখন র্তাহার নাসাতে তিলক ও সর্বাঙ্গে হরিনামের ছাপ দৃষ্ট হইত। -- মানুষটি শ্যামবর্ণ সুস্থ ও সবলদেহ ছিলেন, মুখটি সদভাবে ও ভক্তিতে যেন গদগদ, সে মুখ দেখিলেই কেমন হৃদয় স্বভাবত র্তাহার দিকে আকৃষ্ট হইত। ঘোষজা মহাশয় আপিসে প্রবেশের দ্বারের পার্থের ঘরেই বসিতেন ; এবং যত গাড়ি মাল আমদানি ও রপ্তানি হইত। তাহার হিসাব রাখিতেন । সুতরাং তঁহাকে প্রতিদিন প্ৰাতঃকালে আপিসে প্রবেশের সময়ে অনেকবার এই প্রশ্ন শুনিতে হইত, কী ঘোষজা মশাই, খবর কী ? সব কুশল তো ? আমনি ঘোষজার উত্তর, “আর্জের গোবিন্দের প্রসাদে সবই কুশল ।” ঘোষজা দোলের সময় কিছু ব্যয় করিতেন ; লোকজনকে শ্রদ্ধাসহকারে আহবান করিয়া উত্তমরূপ খাওয়াইতেন । এইজন্য আপিসের লোক মাঘ মাস পড়িলেই জিজ্ঞাসা করিত— “কী ঘোষজা মশাই, এবার দােল করবেন তো ?” অমনি উত্তর— “আজ্ঞে কী জানি, যা গোবিন্দের ইচ্ছা ।” গোবিন্দের প্রতি নিৰ্ভরের ভাব তাহার এমন স্বাভাবিক ছিল যে, আট বৎসর বয়সে ওলাউঠা রোগে তাহার দ্বিতীয় পুত্রটির কাল হইলে, তাহারই তিন-চারি দিন পরে আপিসের একজন লোক জিজ্ঞাসা করিলেন- “কী ঘোষমশাই, ছেলে দুটাে মানুষ হচ্ছে তো ?” ঘোষজ উত্তর করিলেন- “আজ্ঞে দুটাে আর কই ? এখন তো একটি, কেবল বড়োটিই আছে।” প্ৰশ্নকর্তা বিস্মিত হইয়া কহিলেন- “সে ছেলেটির কী হল ?” ঘোষজা উত্তর করিলেন- “আঙ্গে গোবিন্দ সেটিকে নিয়েছেন।”. তিনি সাধ করিয়া নাতি নাতনীদের নাম রাখিয়াছিলেন । পুত্রের সর্বজ্যেষ্ঠা কন্যা হইলে তাহার নাম রাধারানী রাখিলেন- সর্বজ্যেষ্ঠ রাধারানী তাহার প্রথম আদরের ধন ছিল । “রাধে । রাজনন্দিনী । গরবিনী । শ্যামসোহাগিনী ।” বলিয়া যখন ডাকিতেন, তখন এক বৎসরের বালিকা রাধারানী অচিরোদগত-দস্তাবলীশোভিত মুখচন্দ্রে একটু হাসিয়া, বঁপাইয়া তাহার ক্ৰোড়ে গিয়া পড়িত। তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন- “রাখলের সনে প্ৰেম করিস নে রাই!” অমনি চক্ষে জলধারা বহিত ।” এ দিকে শিশুকন্যা টিমিমণি, নবীনের সহিত র্তাহার ভ্রাতৃবধুর সম্বন্ধ, নবীনের রাঙা মা- এগুলিও লেখক বড়ো সরল এবং সরস সুমিষ্টভাবে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন। লেখক ধারাবাহিক গল্পের প্রতি বড়ো-একটা দৃষ্টিপাত করেন নাই- আমরাও গল্পের জন্য বিশেষ লীলায়িত নাহি। আমরা একজন রীতিমত মনুষ্যের আনন্দজনক বিশ্বাসজনক জীবনবৃত্তান্ত চাহিনশিপুর গ্রামে তর্কভূষণ-পরিবারের আদ্যোপান্ত বিবরণ শুনিয়া যাইতে আমাদের কিছুমাত্র শ্ৰান্তিবােধ হইত না ; কারণ, তর্কভূষণ আমাদের হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছেন এবং লেখকও তাহার সূক্ষ্মদৰ্শিনী হাস্যবর্ষিণী কল্পনাশক্তি দ্বারা আমাদের সম্পূর্ণ বিশ্বাস আকর্ষণ করিতে পারিয়াছেন। কিন্তু লেখক দুইখানি বহির পাতা পরস্পর উলটাপালটা করিয়া দিয়া একসঙ্গে বাধাইয়া দপ্তরির অন্ন মারিয়াছেন এবং পাঠকদিগের রসভঙ্গ করিয়াছেন, এ আক্ষেপ আমরা কিছুতেই ভুলিতে পারিব না । SbOS