পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G2brSq রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আর্যগাথা আর্যগাথা । দ্বিতীয় ভাগ ।।শ্ৰীদ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রণীত । গ্ৰন্থখানি সংগীতপুস্তক, এইজন্য ইহার সম্পূর্ণ সমালোচনা সম্ভবে না। কারণ, গানে কথার অপেক্ষা সুরেরই প্রাধান্য । সুর খুলিয়া লইলে অনেক সময়ে গানের কথা অত্যন্ত শ্ৰীহীন এবং অর্থশূন্য হইয়া পড়ে এবং সেইরূপই হওয়া উচিত। কারণ, সংগীতের দ্বারা যখন আমরা ভােব ব্যক্ত করিতে চাহি তখন কথাকে উপলক্ষমাত্র করাই আবশ্যক ; কথার দ্বারাই যদি সকল কথা বলা হইয়া যায়। তবে সংগীত সেখানে খর্ব হইয়া পড়ে। কথার দ্বারা আমরা যাহা ব্যক্ত করিয়া থাকি তাহা বহুলপরিমাণে সুস্পষ্ট সুপরিস্ফুটি- কিন্তু আমাদের মনে অনেক সময় এমন-সকল ভাবের উদয় হয় যাহা নামরূপে নির্দেশ বা বর্ণনায়, প্ৰকাশ করিতে পারি না, যাহা কথার অতীত, যাহা অহৈতুক- সেই সকল ভাব, অন্তরাত্মার সেই সমস্ত আবেগ-উদবেগগুলি সংগীতেই বিশুদ্ধ রূপে ব্যক্ত হইতে পারে। হিন্দুস্থানী গানে কথা এতই যৎসামান্য যে, তাহাতে আমাদের চিত্তকে বিক্ষিপ্ত করিতে পারে না- ননদিয়া, গগরিয়া, চুনরিয়া, আমরা কানে শুনিয়া যাই মাত্র কিন্তু সংগীতের সহস্রাবাহিনী নিঝরিণী সেই সমস্ত কথাকে তুচ্ছ উপলখণ্ডের মতো প্লাবিত করিয়া দিয়া আমাদের হৃদয়ে এক অপূর্ব সৌন্দর্যবেগ, এক অনির্বচনীয় আকুলতার আন্দোলন সঞ্চার করিয়া দেয়। সামান্যত পাথরের নুড়ি বালকের খেলেনা মাত্র, হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ ছেলেখেলা- কিন্তু নিবারের তলে সেই নুড়িগুলি ঘাতে-প্রতিঘাতে জলস্রোতকে মুখরিত করিয়া তোলে, বেগবান প্রবাহকে বিবিধ বাধা দ্বারা উচ্ছসিত করিয়া অপরূপ বৈচিত্ৰ্য দান করে । হিন্দি গানের কথাও সেইরূপ সুরপ্রবাহকে বিচিত্র শব্দসংঘর্ষ এবং বাধার দ্বারা উচ্ছসিত ও প্রতিধ্বনিত করিয়া তোলে, অর্থগৌরব বা কাব্যসৌন্দর্যের দ্বারা তাহাকে অতিক্রম করিতে চেষ্টা করে না । ছন্দ-সম্বন্ধেও এ কথা খাটে । নদী যেমন আপনার পথ আপনি কাটিয়া যায় গানও তেমনি আপনার ছন্দ আপনি গড়িয়া গেলেই ভালো হয়.। অধিকাংশ স্থলেই হিন্দি গানের কথায় কোনো ছন্দ থাকে না— সেইজন্যই ভালো হিন্দি গানের তালের গতিবৈচিত্র্য এমন অভাবিতপূর্ব ও সুন্দর- সে ইচ্ছামত হ্রস্বদীর্ঘের সামঞ্জস্য বিধান করিতে করিতে চলে, স্বাধীনতার সহিত সংযমের সমন্বয় সাধন করিতে করিতে বিজয়ী সম্রাটের ন্যায় গুরুগভীর ভেরীধ্বনি-সহকারে অগ্রসর হইতে থাকে। তাহাকে পূর্বকৃত বাধা ছন্দের মধ্য দিয়া চালনা করিয়া লইয়া গেলে তাহার বৈচিত্র্য এবং গৌরবের হানি হইয়া থাকে । কাব্য স্বরাজ্যে একাধিপত্য করিতে পারে। কিন্তু সংগীতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিতে গেলে তাহার পক্ষে অনধিকারচর্চা হয় । বিশুদ্ধ কাব্য এবং বিশুদ্ধ সংগীত স্ব স্ব অধিকারের মধ্যে স্বতন্ত্রভাবে উৎকর্ষ লাভ করিয়া থাকে, কিন্তু বিদ্যাদেবীগণের মহল পৃথক হইলেও তাহারা কখনো কখনো একত্র মিলিয়া থাকেন। সংগীতে ও কাব্যে মধ্যে মধ্যে সেরাপ মিলন দেখা যায় । তখন উভয়েই পরস্পরের জন্য আপনাকে কথঞ্চিৎ সংকুচিত করিয়া লন, কাব্য আপন বিচিত্ৰ অলংকার পরিত্যাগ করিয়া নিরতিশয় স্বচ্ছতা ও সরলতা অবলম্বন করেন, সংগীতও আপনি তাল সুরের উদ্দাম লীলাভঙ্গকে সংবরণ করিয়া সখ্যভাবে কাব্যের সাহচর্য করিতে থাকেন । হিন্দুস্থানে বিশুদ্ধ সংগীত প্ৰাবল্য লাভ করিয়াছে কিন্তু বঙ্গদেশে কাব্য ও সংগীতের সম্মিলন ঘটিয়াছে। গানের যে-একটি স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য, একটি স্বাধীন পরিণতি তাহা এ দেশে স্থান পায় নাই। কাব্যকে অন্তরের মধ্যে ভালো করিয়া ধ্বনিত করিয়া তুলিবার জন্যই এ দেশে সংগীতের অবতারণা হইয়াছিল। কবিকঙ্কণ চণ্ডী, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি বড়ো বড়ো কাব্যও সুরসহকারে সর্বসাধারণের নিকট পঠিত হইত। বৈষ্ণব কবিদিগের গানগুলিও কাব্য- কেবল চারিদিকে উড়িয়া ছড়াইয়া পড়বার জন্য সুরগুলি তাঁহাদের ডানাস্বরূপ হইয়াছিল। কবিরা যে কাব্য রচনা করিয়াছেন সুর তাঁহাই ঘোষণা করিতেছে মাত্র । বঙ্গদেশের কীর্তনে কাব্য ও সংগীতের সম্মিলন এক আশ্চর্য আকার ধারণ করিয়াছে ; তাহাতে