পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

G S SR রবীন্দ্র-রচনাবলী না । অথচ এই রক্তস্রোতের ভীষণ আবর্তের মধ্য হইতে মাঝে মাঝে দয়াদাক্ষিণ্য ধর্মপরতা রত্নরাজির নায় উৎক্ষিপ্ত হইয়া উঠে । য়ুরোপীয় খৃস্টানজাতির মধ্যেও এই বিশ্বগ্রাসী প্রবৃত্তিক্ষুধা কিরূপ সাংঘাতিক তাহা সমুদ্রতীরের বিলুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় কৃষ্ণ ও রক্তকায় জাতিরা জানে। রূপকথার রাক্ষস যেমন নাসিক উদ্যত করিয়া আছে, আমিষের ব্ৰাণ পাইলেই গর্জন করিয়া উঠে, “হাউ মাউ খাউ মানুষের গন্ধ পাউ"- ইহারা তেমনি কোথাও একটুকরা নূতন জমির সন্ধান পাইলেই দলে দলে চীৎকার করিয়া উঠে, "ইউ মাউ খাউ মাটির গন্ধ পাউ ” উত্তর-আমেরিকার দুৰ্গম তুষারমরুর মধ্যে স্বর্ণখনির সংবাদ পাইয়া লোভোন্মত্ত নরনারীগণ দীপশিখালুব্ধ পতঙ্গের মতো কেমন উর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়াছে, পথের বাধা, প্রাণের ভয়, অন্নকষ্ট কিছুতেই তাহাদিগকে রোধ করিতে পারে নাই, সে বৃত্তান্ত সংবাদপত্ৰে সকলেই পাঠ করিয়াছেন । এই যে অচিন্তনীয় কষ্টসাধন- ইহাতে দেশের উন্নতি করিতে পারে, কিন্তু ইহার লক্ষ্য দেশের উন্নতি, জ্ঞানের অর্জন অথবা আর-কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নহে- ইহার উদ্দীপক দুৰ্দান্ত লোভ। দুৰ্যোধনপ্রমুখ কৌরবগণ যেমন লোভের প্ররোচনায় উত্তরের গোগৃহে ছুটিয়াছিল ইহারাও তেমনি ধরণীর স্বর্ণরস অধিক দিনের কথা নহে, ১৮৭১ খৃস্টাব্দে একটি ইংরাজ দাসদস্যব্যবসায়ী জাহাজে কিরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছিল তাহার বর্ণনা The Wide World Magazine-নামক একটি নূতন সাময়িক পত্রে প্রকাশিত হইয়াছে। ফিজিদ্বীপে যুরোপীয় শস্যক্ষেত্রে মনুষ্য-পিছু তিন পাউণ্ড করিয়া মূল্য দেওয়া হইত। সেই লোভে এক দল দাস-চের যে কিরূপ অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সহিত দক্ষিণসামুদ্রিক দ্বীপপুঞ্জে মনুষ্য শিকার করিত এবং একদা ষাট-সত্তর জন বন্দীকে কিরূপ পিশাচের মতো হত্যা করিয়া সমুদ্রের হাঙর দিয়া খাওয়াইয়াছিল তাহার নিদারুণ বিবরণ পাঠ করিলে খৃস্টানমতের অনন্ত নরকাদণ্ডে বিশ্বাস জন্মে । যে-সকল জাতি বিশ্ববিজয়ী, যাহাদের অসন্তোষ এবং আকাঙক্ষার সীমা নাই, তাহদের সভ্যতার নিম্নকক্ষে শৃঙ্খলবদ্ধ হিংস্রতা ও উচ্ছঙ্খল লোভের যে-একটা পশুশালা গুপ্ত রহিয়াছে, মাঝে মাঝে তাহার আভাস পাইলে কণ্টকিত হইতে হয় । তখন আমাদের মনের মধ্যে এই দ্বন্দ্বের উদয় হয় যে, যে-বৈরাগ্য ভারতবষীয় প্রকৃতিকে পরের অন্নে হস্তপ্রসারণ হইতে নিবৃত্ত করিয়া রাখিয়াছে, দুর্ভিক্ষের উপবাসের দিনেও যাহা তাহাকে শান্তভাবে মরিতে দেয়, তাহা স্বাের্থরক্ষার পক্ষে উপযোগী নহে বটে, তথাপি যখন মুসলমানদের ইতিহাসে দেখি উদাম প্রবৃত্তির উত্তেজনার সম্মুখে, ক্ষমতা লাভ স্বার্থসাধন সিংহাসনপ্ৰাপ্তির নিকটে স্বাভাবিক স্নেহ দয়া ধর্ম সমস্তই তুচ্ছ হইয়া যায় ; ভাই-ভাই, পিতাপুত্র, স্বামীশ্ৰী, প্ৰভুভুত্যের মধ্যে বিদ্রোহ বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, রক্তপাত এবং অকথ্য অনৈসৰ্গিক নির্মমতার প্রাদুর্ভাব হয়, যখন খৃস্টান ইতিহাসে দেখা যায় আমেরিকায় অস্ট্রেলিয়ায় মাটির লোভে অসহায় দেশবাসীদিগকে পশুদলের মতো উৎসাদিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে, লোভান্ধ দাসব্যবসায়িগণ মানুষকে মানুষ জ্ঞান করে নাই, যখন দেখিতে পাই পৃথিবীটাকে ভাঙিয়া-চুরিয়া নিজের কবলে পুরিবার জন্য সর্বপ্রকার বাধা অমান্য করিতে মানুষ প্ৰস্তুত- ক্লাইভ, হেস্টিংস তাঁহাদের নিকট মহাপুরুষ এবং সফলতা লাভ রাজনীতির শেষ নীতিতখন ভাবি শ্রেয়ের পথ কোন দিকে ! যদিও জানি যে-বল পশুত্বকে উত্তেজিত করে, সেই বল সময়ক্রমে দেবত্বকে উদবোধিত করে, জানি যেখানে আসক্তি প্রবল সেইখানেই আসক্তিত্যাগ সুমহৎ জানি বৈরাগ্যধর্মের ঔদাসীন্য যেমন প্রকৃতিকে দমন করে তেমনি মনুষ্যত্বে অসাড়তা আনে এবং ইহাও জ্যোতি— জানি যে, যেখানে মনুষ্যপ্রকৃতির বলশালিতাবশত প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির সংঘর্ষ প্রচণ্ড সেইখানেই দেবগণের ভোগে বিশুদ্ধতম আধ্যাত্মিক অমৃত উন্মথিত হইয়া উঠে, তথাপি লোভ-হিংসার ভীষণ আন্দোলন এবং বিলাসলালসার নিয়ত চাঞ্চল্যের দৃষ্টান্ত দেখিলে ক্ষণকালের জন্য দ্বিধা উপস্থিত হয়, মনে সন্দেহ জাগে যে, পাপ-পুণ্যের ভালো-মন্দের এইরূপ উদ্ভুঙ্গ তরঙ্গিত অসাম্য শ্রেয়, না,