পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য (6: - সুত্রকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয়, কিন্তু সেই সকল অনিবাৰ্য বাধাসত্ত্বেও লেখক তাহার ইতিবৃত্তকে কাহিনীর ন্যায় মনোরম করিয়া তুলিয়াছেন, এবং ইতিহাসের চিরাপরাধী অপবাদগ্ৰস্ত দুৰ্ভাগা সিরাজদ্দৌলার জন্য পাঠকের করুণা উদ্দীপন করিয়া। তবে ক্ষান্ত হইয়াছেন । কেবল একটা বিষয়ে তিনি ইতিহাস-নীতি লঙ্ঘন করিয়াছেন । গ্রন্থকার যদিচ সিরাজচরিত্রের কোনো দোষ গোপন করিতে চেষ্টা করেন নাই, তথাপি কিঞ্চিৎ উদ্যমসহকারে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন । শান্তভাবে কেবল ইতিহাসের সাক্ষ্য দ্বারা সকল কথা ব্যক্ত না করিয়া সঙ্গে সঙ্গে নিজের মত কিঞ্চিৎ অধৈর্য ও আবেগের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন। সুদৃঢ় প্রতিকূল সংস্কারের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া এবং প্রচলিত বিশ্বাসের অন্ধ অন্যায়পরতার দ্বারা পদে পদে ক্ষুব্ধ হইয়া তিনি স্বভাবতই এইরূপ বিচলিত ভােব প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহাতে সত্যের শান্তি নষ্ট হইয়াছে এবং পক্ষপাতের অমূলক আশঙ্কায় পাঠকের মনে মধ্যে মধ্যে ঈষৎ উদবেগের সঞ্চার করিয়াছে। (अर्छ »७०@ ܔ শ্ৰীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয় মহাশয়ের ‘সিরাজদ্দৌলা' পাঠ করিয়া কোনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পত্ৰ ক্ৰোধ প্ৰকাশ করিয়াছেন । স্বজাতি সম্বন্ধে পরের নিকট হইতে নিন্দােক্তি শুনিলে ক্ৰোধ হইতেই পারে। সমূলক হইলেও । কিন্তু আমাদের সহিত উক্ত পত্ৰসম্পাদকের কত প্ৰভেদ ! আমাদিগকে বিদেশীলিখিত নিন্দোক্তি বাধ্য হইয়া অধ্যয়ন করিতে হয়, তাহা মুখস্থ করিয়া পরীক্ষা দিতে হয়। কিন্তু অক্ষয়বাবুর সিরাজদ্দৌলা কোনো কালে সম্পাদক মহাশয়ের সন্তানবগের পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত হইবার সম্ভাবনা দেখি না । বিশেষত অক্ষয়বাবু এই গ্ৰন্থ যখন বাংলায় রচনা করিয়াছেন তখন ইংরাজ পাঠককে ব্যথিত করিবার কিন্তু এই বাংলা রচনাতেই সমালোচক আক্রোশের কারণ আরো অধিক দেখিতে পাইয়াছেন । তিনি আশঙ্কা করেন, ভাষানভিজ্ঞতাবশত যে-সকল বাঙালি পাঠকের নিকট মূল দলিল এবং ঐতিহাসিক প্রমাণ-সকল আয়ত্তাতীত, ‘সিরাজদ্দৌলা’ গ্ৰন্থ পাঠে ইংরাজদিগের আচরণের প্রতি তাহাদের অশ্রদ্ধা জন্মিতে পারে । কিন্তু ইহা ইতিহাস ; যুক্তির দ্বারা প্রমাণের দ্বারা ইহাকে আক্রমণ করিয়া ধ্বংস করিয়া দেওয়া কঠিন । নহে । এমন-কি, আইনের কোনো অভাবনীয় ব্যাখ্যায় ইতিহাসসমেত ঐতিহাসিককেও লোপ করিয়া দেওয়া অসম্ভব না হইতে পারে। কিন্তু জিজ্ঞাস্য এই যে, তুলনায় কোনটা গুরুতর- ইংরাজ লেখকগণ গল্পে প্রবন্ধে ভ্ৰমণবৃত্তান্তে প্রাচ্যজাতীয়দের প্রতি নানা আকারে যে নিন্দা ও অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছেন, যাহা অধিকাংশ স্থলেই যুক্তিগত তথ্যগত নহে, জাতীয় সংস্কারগত- অধিকাংশ স্থলেই *RR irst F. Rigs crpretts IsiGs sistics. The dislike for aliens'- ইহাই, অথবা বাংলা ইতিহাস যাহা শিক্ষিত বাঙালিদেরও বারো-আনা লোক বাংলায় লিখিত বলিয়াই পড়িতে অনাদর করিবে, তাহা ? আমাদের প্রতি ইংরাজের যে ধারণা জন্মিয় থাকে তাহার ফল প্রত্যক্ষ- কারণ, আমরা নিরুপায়ভাবে ইংরাজের হস্তগত । একে দুর্বল অধীন আজ্ঞাবাহের প্রতি স্বভাবতই উপেক্ষা জন্মে এবং সেই উপেক্ষা সদবিচারের ব্যাঘাত না করিয়া থাকিতে পারে না, তাহার পরে শিশুকাল হইতে ইংরাজসন্তান যে-সকল গ্ৰন্থ পাঠ করে তাহাতে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বীভৎসা এবং বিভীষিকার উদ্রেক করিয়া দেয়। ভারতবর্ষের ধর্ম, সমাজ এবং লোকচরিত্র সম্বন্ধে ভূয়োভুয় কাল্পনিক মিথ্যাবাদ ও অত্ম্যুক্তি দ্বারা পরিপূর্ণ ইংরাজি গ্রন্থের পত্রসংখ্যার সহিত তুলিত হইলে বঙ্গসাহিত্যের ভালোমন্দ পাঠ্য অপাঠ্য সমস্ত গ্রন্থ আপন ক্ষীণতাক্ষোভে লজ্জিত হইয়া উঠে। ]