পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዪ9Obr রবীন্দ্র-রচনাবলী “ভালো করিয়া লিখিতে গেলে স্বাভাবিক অনায়াসীতা এবং অভ্যন্ত আয়াসের প্রয়োজন ।” পূর্বোক্ত কথাটার তাৎপর্য এই যে, ভালো লেখকের লিখনশক্তিটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই শক্তিটাকে বিচারের দ্বারা পদে পদে নিয়মিত করাটা অভ্যাসীসাধ্য । সেই স্বাভাবিক শক্তির সঙ্গে যখন এই অভ্যস্ত শক্তির সম্মিলন হয় তখনই যথার্থ ভালো লেখা বাহির হয় । ভালো লেখক অনায়াসেই লিখিতে পারে, কিন্তু লিখিবার জন্য পদে পদে আয়াস স্বীকার করিয়া থাকে । ‘প্রাচুর্যের ক্ষমতােটা লেখকের থাকা চাই, অথচ তাহা ব্যবহার করিয়া যেন সে অপরাধী না হয়। কারণ, কাগজ ধৈর্যশীল, পাঠক ধৈর্যশীল নহে; পাঠকদের ক্ষুধা অপেক্ষা পাঠকের মুখ মরিয়া যাওয়াকেই বেশি ভয় করা উচিত।” 鸭 ‘প্রতিভা মহৎকার্যের সূত্রপাত করে কিন্তু পরিশ্রম তাহা সমাধা করিয়া দেয়।” ‘একটা ভালো বই রচনা করিতে তিনটি জিনিসের দরকার- ক্ষমতা, বিদ্যা এবং নৈপুণ্য। অর্থাৎ স্বভাব, পরিশ্রম এবং অভ্যাস ।” ‘লিখিবার সময় কল্পনা করিতে হইবে যেন বাছা বাছা কয়েকজন সুশিক্ষিত লোকের সম্মুখে উপস্থিত আছি অথচ তাহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া লিখিতেছি না ।” অর্থাৎ লেখা কেবল বাছা বাছা লোকের পড়িবার যোগ্য হইলে হইবে না ; তাহা জনসাধারণের উপযুক্ত হইবে অথচ বিশিষ্ট মণ্ডলীর পছন্দসই হওয়া চাই। "ভাবকে তখনই সম্পূর্ণ বলা যায় যখন তাহা হাতের কাছে প্রস্তুত হইয়া আসে- অর্থাৎ যখন তাহাকে যেমন ইচ্ছা পৃথক করিয়া লওয়া এবং যেখানে ইচ্ছা স্থাপন করা যায়।” অধিকাংশ লোকেরই মনে অধিকাংশ ভােব জড়িত-মিশ্রিত অবস্থায় থাকে, তাহাদিগকে আকারবদ্ধ ও পৃথক করিয়া লইতে না পারিলে বিশেষ কাজে লাগানো যায় না। জুবেয়ার নিজে সর্বদাই তাহার ভাবগুলিকে আকার ও স্বাতন্ত্র্য দান করিয়া তাহদের প্রত্যেকটিকে যেন ব্যবহারযোগ্য করিয়া বুলেগছিলেন। এইরূপে স্থার মেনর প্রত্যেক ভাবের সহিত স্পষ্ট পরিচয় স্থাপনকাই উহার কাজ ‘রচনাকালে, আমরা যে কী বলিতে চাই তাহা ঠিকটি জানি না, যতক্ষণ না বলিয়া ফেলি । বস্তুত কথাই ভাবকে সম্পূর্ণতা এবং অস্তিত্ব দান করে।” ‘ভালো সাহিত্যগ্রন্থে উন্মত্ত করে না, মুগ্ধ করে।” 曲 “যাহা বিস্ময়কর তাহা একবার মাত্র বিস্মিত করে, যাহা মনোহর তাহার মনোহারিতা উত্তরোত্তর বাড়িতে থাকে ৷” লেখার স্টাইল সম্বন্ধে জুবেয়ারের অনেকগুলি বচন আছে। কিন্তু স্টাইলকে বাংলায় কী বলিব ? চলিত শব্দ হইলেই ভালো হয়, আলংকারিক পরিভাষা সর্বদা ব্যবহারযোগ্য হয় না । বাংলা ছাদ কথা স্টাইলের মোটামুটি প্রতিশব্দ বলা যাইতে পারে। কিন্তু তাহার দোষ এই যে, শুধু ছাদ কথাটা ব্যবহার বাংলায় রীতি নহে। বলিবার ছাদ, লিখিবার ছাদ ইত্যাদি না বলিলে কথাটা সম্পূর্ণ হয় না। সংস্কৃত ভাষায় স্থলবিশেষে রীতি শব্দে স্টাইল বুঝায়। যথা মাগধী রীতি বৈদভী রীতি ইত্যাদি। মগধে যে বিশেষ স্টাইল প্রচলিত তাঁহাই মাগধী রীতি, বিন্দর্ভের প্রচলিত স্টাইল বৈদভী রীতি। এইরূপ, ব্যক্তিবিশেষের লেখায় তাহার একটি স্বকীয় রীতিও থাকিতে পারে- য়ুরোপীয় অলংকারে সেই স্টাইলের বহুল আলোচনা দেখা যায় । তথাপি অনুবাদ করিতে বসিলে দেখা যাইবে, রীতি অথবা ছাদ সর্বত্রই স্টাইলের প্রতিশব্দরূপে প্রয়োগ করিলে ভাষার প্রথা-বিরুদ্ধ হইয়া পড়ে। একটি উদাহরণ দিই। ; জুবেয়ার বলিয়াছেন, স্টাইলের beft vs GT R (Beware of tricks of style) age if eqrt “if a sic চলে না। কিন্তু একটু ঘুরাইয়া বলিলে কাজ চালানো যায়- লেখার ছাদের মধ্যে যদি চালাকি থাকে তাহা দেখিয়া ভুলিয়ে না— অথবা, লিখনরীতির চাতুরীতে ভুলিয়াে না। কিন্তু যেখানে স্টাইল কথাটা ব্যবহার করিলে সুবিধা পাওয়া যাইবে সেখানে আমরা প্রতিশব্দ বসাইবার চেষ্টা করিব না।